"পাঠক,পাঠিকাদের মতামত বা মন্তব্যই তো লেখকদের লেখিকাদের পুনরায় লিখিবার একমাত্র প্রেরণা। তাই দয়া করিয়া মতামত দিতে ভুলিবেন না, তা সে যেমনই হউক না কেন ।" http://tobey-shono.blogspot.com

Sunday, March 4, 2012

পাতিলেবু, ছানা, ইত্যাদি

কি বিপদ! কি বিপদ!! কি বিপদ!!! দুগ্ধ হইতে প্রস্তুত ছানা দিয়া কি প্রকার এক খাদ্য প্রস্তুত করিবেন আমার গৃহিণী। তাহাতে দোষ নাই। তবে ভালো না লাগিলেও হাস্যমুখে কহিতে হইবে বেশ খাইতে হইয়াছে, উত্তম হইয়াছে। আবার খাইতে ইচ্ছা হয়। খুব শীঘ্রই আবার ইহা প্রস্তুত করিও। তবে সে তো অনেক পরের ব্যাপার। দুগ্ধ হইতে ছানা প্রস্তুত করিতে পাতিলেবুর রস লাগে। আমার পুত্র ঠিকমতো চিনিয়া, বাছিয়া বাজার হইতে দুইটি পাতিলেবু লইয়া আসিয়াছে। দুঃখ এই, দুইটি পাতিলেবুই হরিৎ বর্ণের, অর্থাৎ কিনা কাঁচা, এবং কঠিন অর্থাৎ শক্ত। এইবার তলব পরিলো আমার। "লেবু হইতে রস বাহির করিয়া দুগ্ধে নিক্ষেপ করিয়া যাও, ইহারা বড় কঠিন", রান্নাঘর হইতে গৃহিণীর কণ্ঠস্বর কানে আসিয়া পৌঁছাইলো। অতএব কাজ ছাড়িয়া উঠিলাম।

গরম দুগ্ধের উপর আধখানা লেবু হাতে লইয়া কচলাইতে শুরু করিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই বুঝিলাম কেন আমার তলব পরিয়াছে। আমি কহিলাম, "আমি কি হাতি যে পদতলে সকল কিছুকে দলিয়া পিষ্ট করিতে পারিব?" গৃহিণী ঈষৎ হাসিল। এক এক করিয়া দুইটি লেবুর চারিটি ফালি হইতে প্রাণপণ শক্তিতে রস নির্গত করিয়া দুগ্ধে নিক্ষেপ করিলাম। কচলানোর সময় ভীষণ সাবধানতা অবলম্বন করিতে হইল। হাত ফসকাইয়া লেবুর খণ্ডটি দুগ্ধে পড়িয়া গেলে লেবুর বাকি খণ্ডগুলি দিয়া আমার ছানা প্রস্তুত হইত। যাহা হউক, কোনও বিড়ম্বনা ঘটিল না। ছানা প্রস্তুত হইল। আমি রান্নাঘর হইতে প্রস্থান করিলাম। এইবারের মত রক্ষা পাইলাম বটে, তবে প্রায়শই আমার ওই লেবুর খণ্ডগুলির মত দশা হয়। গৃহিণীর দ্বারা নিংড়ানো, কচলানোর হাত হইতে কে কবে বাঁচিয়াছে?

ছানা দিয়া প্রস্তুত খাদ্যটি কেমন হইয়াছিল তাহা না খাইয়া বলিতে পারিলাম না। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা বিশেষ আশার সঞ্চার করে না।

ওই যে টিকটিকি নামক প্রাণীটি, উহাকে আমি ডাকিয়া আমার বাসগৃহে আনি নাই। কিন্তু হইবে কি? রান্নাঘরে টিকটিকি দেখিলেই হইল। আমার দশা হইয়া পড়ে টিকটিকির চাইতেও করুণ। "ভেবেছ কি? বলি ভেবেছ কি? আমার রান্নাঘরে টিকটিকি, আর তুমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমবে?" এমন বাক্য প্রায়ই শুনি। টিকটিকি কি আমার পোষা? আর টিকটিকি পুষিয়া যদি সন্তুষ্ট থাকিতে পারিতাম, তবে কি আর আমার এই দশা হইত? টিকটিকি বা আরশোলা তাড়াইবার যন্ত্রটা খুব সম্ভব আমারই নাকি আবিষ্কার করা উচিত ছিল। না পারাটাই আমার ঘোর অক্ষমতা। আহা! বাদ পড়িয়া গেছে। ওই যে আটটি পা বিশিষ্ট প্রাণীটি, মাকড়শা যার চলতি নাম, যদি দেখা যায় কোথাও, তবে আর কথা নাই। একবার চিৎকার করিয়াই সব স্তব্ধ। শয়নকক্ষে বাঘ দেখিলে ঠিক যেমনটি হয়। পিটাইয়া মাকড়শা মারিবার জন্য একটি ঝ্যাঁটা রাখা আছে কিন্তু মাকড়শা প্রাণীটি বাস্তবিকই চতুর। মাকড়শার চতুরতার সঙ্গে আমি ঠিক জড়াইয়া পরি।

বাজার হইতে ফরমাসের কোনও জিনিস আনিতে ভুলিয়া গেলে চলিবে না। অধিকাংশ সময়ই পুনরায় বাজার যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও গতি থাকে না। কে যেন একসময়ে বলিয়াছিল, সব কিছুর জন্য তো আর ঈশ্বর বা সরকারকে দায়ী করা যায় না। তাই গৃহস্বামীকেই অধিকাংশ অঘটনের জন্য আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। আস্তে আস্তে গোটা জীবনটাই কাঠগড়ার চেহারা লইয়া তিন দিক হইতে ঘিরিয়া ফেলিতে থাকে। কাঠগড়ার একটি দিক অবশ্যই খোলা। তবে খোলা দিকটিতে কড়া পাহারা সর্বদাই মোতায়েন থাকে। গৃহস্বামীটির জেল হয় না কখনও। কিছুটা আনন্দ-নিরানন্দের সহিত সে চিরকাল গৃহপালিত অবস্থায় কাঠগড়াতেই দণ্ডায়মান থাকে।

Wednesday, February 22, 2012

অপ্রাসঙ্গিক কথা

মোটেই বাজে বকবক করিতে বসি নাই। আমার বিস্তর কাজ আছে। ছবি আঁকি, গল্প, কবিতা লিখি, আবার কখনও, কখনও অর্থনীতির ও আধ্যাত্মিকতার চর্চা করিয়া থাকি। ছবি আঁকা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। রঙ, তুলি, কাগজ, পেন্সিল, তেল, জল, কত কি লাগে। তবে দেখিবেন, আমি যে এ কথা বলিলাম তা আবার ওই ওপরওয়ালাকে জানাইবেন না। আসলে আমাকে সকল রকম কাজ করিতে সেই তো সাহায্য করে। সে শুনিলে রাগ করিতে পারে। না হইলে আমি তো একটা পয়লা নম্বরের অকেজো মানুষ। তাই মান, মর্যাদা বিশেষ পাই না। দিনের বেশির ভাগ সময়েই আকাশ দেখি, তারা গুনি, গাছের পাতা গুনি, পাখি দেখি, গান শুনি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আপনি আবার এইসব অকেজো মানুষদের গুণগুলি রপ্ত করিবেন না যেন। তবেই সর্বনাশ!

তবে এই জীবন নামক বস্তুটাকে একেবারে উপেক্ষা করতে পারি না। জীবন, জীবিকা, প্রাণ, আত্মা, কর্ম, মায়া, এগুলির সবকয়টিয়ই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। আলোচনার মাঝে এগুলির কথা সবাই বারবার বলে। জন্মের পর হইতে বহু বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। কিন্তু আজও জীবন নামক বস্তুটি যে কি তাহা বুঝিলাম না। বনে, জঙ্গলে, পাহাড় পর্বতের আশেপাশে অনেক খুঁজিয়াছি, বুঝিলেন। পাই নাই। তাকে সামনে পাইলে জিজ্ঞাসা করিতাম, আচ্ছা মশাই, আমার রক্তমাংস-অস্থিপূর্ণ শরীরে আত্মা নামক কি একটা গুঁজিয়া দিয়া, আমার মধ্যে পরস্পরবিরোধী কতগুলি ইচ্ছার সঞ্চার করিয়া এবং হাত, পা ছুঁড়িতে শিখাইয়া সেই যে অদৃশ্য হইলেন, আর তো আপনার দেখা পাইলাম না। পড়ে অবশ্য হাঁটিতে শিখিয়াছি, এবং তার সঙ্গে আরও কত কি শিখিয়াছি। কিন্তু উদর ভরিবার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করিলে হইত না? ওই ব্যবস্থাটি বরাবরই বড় কাঁচা রহিয়া গেলো। অতীতে না জানিয়া, বিষাক্ত ফল খাইয়া কত লোকের মৃত্যু হইল। এক্ষণে অবশ্য আর এমনটা ঘটে না। আসল কথা জীবন আমাদিগের একান্ত আপনার, খুবই কাছের। তাহাকে আমরা বৃথাই দূর, দূরান্তে খুঁজিয়া মরি। তাহাকে চিনিবার, জানিবার ব্যবস্থা আমাদের অন্তরেই রহিয়াছে। ওই যে আত্মা নামক বস্তুটি, যার মৃত্যু নাই, বিনাশ নাই, যাহাকে আমরা কখনও, কখনও প্রাণও বলিয়া থাকি, সেই সব বলিয়া দেয়, সকল কিছুর খোঁজ দেয়। আত্মার ডাকে সারা দিবার অভ্যাস একবার রপ্ত করিতে পারিলে জীবনকে সঠিক পথে চালাইবার নিয়মগুলি সবই জানা হইয়া যায়।

আত্মার ডাকে সাড়া দিতে বাধ সাধে আমাদের 'আমি'-টি। আমি ও আমার, এই করিয়াই আমরা সারা জীবন কাটাইয়া দেই, আত্মার দিকে একবার ফিরিয়াও তাকাই না। সে বেচারা অন্ধকারে বসিয়া গুমরাইয়া কাঁদে। 'আমি' বস্তুটির প্রয়োজন হইল সে আহরণ করে। আহরিত বস্তুগুলির উপর মালিকানার সীলমোহর লাগায়। তবে বস্তুর উপর তার অধিকার জন্মায়। আহরিত বস্তু জ্ঞানও হইতে পারে। ওই আহরিত বস্তুগুলির কিছু দিয়া জীবিকার কাজ বেশ চলিয়া যায়। এবার প্রশ্ন হইল, অধিকার কেন? কোনও কিছুর উপর অধিকার না থাকিলে তো তা দান করা যায় না। আবার দান কেন? এই তো বেশ আহরণ, মালিকানা ইত্যাদি লইয়া সুখের কথা হইতেছিল। দানের প্রয়োজন ওই আত্মার ক্রন্দন বন্ধ করিবার জন্য। সে যে একমাত্র দানেই তুষ্ট, দানেই শুদ্ধ। অতএব আহরণ ও দান, এই দুইয়েরই প্রয়োজন আছে। কর্মের মাধ্যমে হয় আহরণ, উৎসবের দিনে হয় দান। এরই মধ্য দিয়া জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়।

এবার বলি, অতীতে যে কয়জন মানুষকে এই কথা কহিয়াছি, তাহারা এক্ষণে আমাকে এড়াইয়া চলে, আমার সামনে বেশীক্ষণ বসে না। আপনারাও কি ভবিষ্যতে উহাদের মত আমার নিকট হইতে পলায়ন করিবেন?

Friday, February 10, 2012

ছাগলের পাকস্থলী

বটুকবাবু আমার বাড়ির বিপরীতেই থাকেন। ভদ্র, সচ্চরিত্র, মাঝবয়সী, সংসারী মানুষ। জীবজন্তু লইয়া অনেক পড়াশুনা করিয়া এক্ষণে এক জীবজন্তুর হাঁসপাতালে হিসাবরক্ষকের কাজ করেন। কিসের হিসাব রাখেন আমি অবশ্য জানি না।

এ হেন বটুকবাবু একদিন হাঁসপাতাল হইতে যখন ফিরিলেন তখন তার কোলে দেখা গেলো একটি ছাগল। সকলে ভাবিল পাঠা, কাটিয়া খাইবেন। পরে জানা গেলো ওটি একটি মেয়ে পাঠা, অর্থাৎ কিনা ছাগল। তা হউক না ছাগল, দোষের কি। ছাগল গৃহপালিত পশু, দুধ দেয়, ম্যা, ম্যা করিয়া ডাকে এবং কামড়ায় না। দুই দিন বাদে জানা গেলো ছাগলটি বটুকবাবু পুষিবার জন্য আনিয়াছেন। তা গ্রামে, গঞ্জে তো লোকে ছাগল পুষিয়াই থাকে। তবে কিনা কলিকাতার মত শহরের এক সম্ভ্রান্ত পল্লীতে গৃহে ছাগল? এ পর্যন্তও মানিয়া লওয়া গেলো।

প্রতিদিন সকালে দেখি বটুকবাবু ছাগলটির সামনের দুই পা উপরে তুলিয়া ধরিয়া তাকে পিছনের দুই পায়ে হাঁটানোর চেষ্টা করিতেছেন। একদিন আমাকে রাস্তায় ধরিয়া ছাগলের পাকস্থলীর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনাইলেন বটুকবাবু। পাকস্থলীর ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে নাকি দুই পায়ে হাঁটিবার বিশেষ সম্বন্ধ রহিয়াছে। শুনিলাম, বুঝিলাম না কিছুই। হয়ত ভালো করিয়া শুনি নাই। ছাগলের পাকস্থলীর খবরে আমার কি কাজ তাহাও বুঝিলাম না।

যাহা হউক, একদিন এক কাণ্ড ঘটিলো। বটুকবাবুর স্ত্রী একটি উঁচু জায়গায় ডালের বড়ি রোদ্দুরে রাখিয়াছিলেন, শুকাইবার জন্য। ছাগলটি কাছেই বাঁধা ছিল। কিছুক্ষণ বাদে আসিয়া দেখেন ছাগলটি সামনের দুইটি পা উঁচু জায়গাটিতে তুলিয়া আপন মনে সেই কাঁচা ডালের বড়ি চিবাইতেছে। পাশেই ঝুলিতেছিল বটুকবাবুর স্ত্রীর একখানি শাড়ি, শুকাইতে দেওয়া। ছাগলটি তারও কিয়দংশ খাইয়া ফেলিয়াছে। দেখিয়া বটুকবাবুর স্ত্রী তো রাগিয়া আগুন।

তিনি বলিলেন, "এ কি করেছিস?"
ছাগলটি দাঁড়ানো অবস্থাতেই ডাকিয়া উঠিল, "ম্যা।"
বটুকবাবুর স্ত্রী বলিলেন, "কে তো মা? দাঁড়া, আজ তোর বাবা আসুক। এ বাড়িতে হয় তুই থাকবি, নয় আমি থাকব।"
ছাগলটি আবার ডাকিল, "ম্যা।"
বটুকবাবুর স্ত্রী মুখ ঘুরাইয়া ঘরে ঢুকিয়া গেলেন। এই বিস্তারিত বিবরণ আমি আমার স্ত্রীর নিকট হইতে শুনি। বিবরণে কিছু বাদ পরিয়াছিল কিনা কহিতে পারি না। তবে যা শুনিলাম, তাহাই যথেষ্ট। বটুকবাবু গৃহে ফিরিবার পর যা ঘটিলো তাহা সহজেই অনুমেয়। ছাগলটিকে আর পরদিন হইতে দেখিতে পাই নাই।

তবে বটুকবাবু, তার স্ত্রী ও ছাগলটি, এই তিনজনের মধ্যে বুদ্ধির প্রতিযোগিতায় ফলটি যা দাঁড়াইল, মানুষ হইয়া তাহা আমি কোনোমতেই মানিয়া লইতে পারিলাম না।

Thursday, February 9, 2012

পরাণের মানুষ

পাইলাম না তো এহনো রে
সঙ্গে চলার সাথী,
হেইয়ার লইগ্যা আইজও আমি
প্রেমের মালা গাঁথি।
মনের মানুষ কয় যে কারে
বোঝে না তো দুনিয়া,
পলাইয়া যায় হগল মানুষ
কথাডা না শুনিয়া।
মনের লগে মন মিলাইলে
বাইথে হয় না বৈঠা,
এ্যমনে চলে জীবন-নৌকা
না খাটাইয়া পালডা।
চলিয়া যে যায় ব্যবাক মানুষ
কাম ফুরাইয়া গ্যলে,
শুকনা মালার লইয়া আমার
ক্যমনে গো দিন চলে।
পরাণের মানুষ কথায় তুমি
কথায় তুমি সাথী,
আশা লইয়া আইজও আমি
প্রেমের মালা গাঁথি।।


- কবিতাটি সুদ্ধ বরিশালের ভাষায় রচিত - ২০১২

Monday, February 6, 2012

একটি ভুতের জবানবন্দী

কি আর বলব আপনাকে? ভুত সমাজে আর মান সম্মান থাকবে না আমাদের। মানুষগুলো কি ভয়ানক বেড়ে উঠেছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমরা ভুত, ভয় দেখানো আমাদের বহু প্রাচীন পেশা। প্রাগৈতিহাসিক যুগেও ভুত ছিল। আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আমাদের সমাজে ভয় দেখানোর ক্ষমতাটা সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ছারপত্র। আমাদের বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে গেলে আগেই দেখে বাচ্চার বাবা এযাবৎ কয়টা ভুতুড়ে বাড়িতে থেকে কতজন মানুষকে ভয় দেখিয়েছে। কি ভাবছেন? সব হিসেব রাখতে হয় আমাদের। আপনাদের মত আমাদের বায়েও-ডেটা হয় না। ওটা খুব সেকেলে পদ্ধতি। তা ছাড়া কাগজ পত্তরের ব্যবহার আমাদের উঠে গেছে পাঁচ হাজার বছর আগে। আমাদের ভয় দেখানোর হিসেব আপনা-আপনি নিকটবর্তী নীম অথবা শ্যাওড়া গাছের কোটরে জমা পরতে থাকে। নীম, শ্যাওড়ার সঙ্গে আমাদের বহুকাল ধরে লেন দেন হয়ে আসছে কিনা। আমরা ওই গাছ দুটোকে খুব বিশ্বাস করি। এইতো দেখুন, কেলে পেত্নী গত বছর তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে পারলো না। কারণ এক বাড়িতে গিয়ে ভয় দেখানো তো দূরের কথা, সে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেই অজ্ঞান হয়ে পরেছিল। মানুষগুলো অবিশ্যি বুঝতে পারেনি। তাই রক্ষা। আমরা সঙ্গে যারা ছিলাম, তারা গোবর জলের ছিটে দিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরাই। এখন বছর পাঁচেক সে কোনও ভয় দেখানোর কাজই পাবে না। ছেলেটাও তাঁর মুক্ষু হয়ে থাকবে। তবেই বুঝতে পারছেন কেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটা।

যাই হোক, মানুষের ঔদ্ধত্য বেড়ে ওঠার কথা বলছিলাম। আমার ঠাকুরদা ছিলেন ওই আমাদের প্রাথমিক স্কুলের খুব জাঁদরেল মাস্টারমশাই। তিনি যে সব ভয় দেখানোর পদ্ধতি শেখাতেন, তা কোনোদিন বিফলে যেত না। নিচু ক্লাস থেকেই বাচ্চারা খুব ওস্তাদ হয়ে উঠত। বছর পঞ্চাশেক আগেও আমরা একটু খাট, বিছানা নাড়া দিলে মানুষগুলো ভয়ে কাঁপতো। গুঙিয়ে মরা কান্না জুড়লে তো আর কথাই নেই। প্রায় অক্কা। স্কন্ধকাটা হয়ে মানুষের সামনে চলাফেরা করা আজকাল আর হয় না। ওতে মানুষের অক্কা পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভুল করবেন না, ভুতেদের মধ্যেও কতগুলি নীতিবোধ আছে। সেই মানুষগুলো আজকাল বলে কিনা ভুত বলে কিছু নেই। মানুষের বাচ্চাগুলো আমাদের দেখে ভেঙচি কাটে। কি লজ্জা, কি লজ্জা।

বলে রাখি, আমার বয়স আড়াইশোর কাছাকাছি। মরেছিলাম বিষ খেয়ে। খুব কড়া বিষ ছিল। অপঘাতে মৃত্যু কিনা, তাই ভুত হয়েছি। মানুষের ভাষায় আমি হলাম মামদো। কি বিচ্ছিরি নাম বলুন তো। আসলে আমাদের কোনও নাম হয়ে না। আমাদের নির্দেশিকা সংখ্যা হয়। আমার সংখ্যা ৩৫০২০০ । প্রথম দুটো নম্বর হোলো আমি এযাবৎ কয়টি বাড়িকে ভুতুড়ে করে রেখেছিলাম। পরের দুটো সংখ্যা হোলো ভয় দেখানোর কাজ শেষ করতে আমার কত মিনিট লাগে। আর শেষ দুটো সংখ্যা হোলো আমি কয়বার বিফল হয়েছি। বুঝতেই পারছেন, একবারও নয়। এখানে আমাকে সবাই ওই নম্বরেই চেনে। আমি কাজ করি মশানতলার ঘাটে। রাত নটা থেকে রাত তিনটে পর্যন্ত থাকতে হয় ওই ঘাটে। এক রাতে বাড়তি দু ঘণ্টা কাজ করলে দু দিন ছুটি পাই। দু বছর বাদে আমি হেড-অফিসে বদলি হয়ে যাবো। জঙ্গলের শেষ প্রান্তে দেখবেন তিনটে নীমগাছ এক জায়গায় আছে। ওটাই আমাদের হেড-অফিস। তখন নীমের ডালে বসে দিব্যি ঠ্যাং নাড়াতে পারবো।

একটা কথা বলে রাখি। এসব কথা খবরের কাগজের লোকেদের দয়া করে জানাবেন না। আমরা প্রচার একদম পছন্দ করি না।

তাই বলছিলাম, মানুষগুলো আমাদের কি বিচ্ছিরি সব নাম দিয়েছে। আমাদের মধ্যে বিধবা মেয়ে-ভুত যারা, তাদের অবশ্য করে মাছ খেতে হয়। এটাই আমাদের নিয়ম। মানুষগুলো তাদের বলে কিনা মেছো-পেত্নী। হতভাগা, মাছ কি তারা সখ করে খায়? নইলে জানবেন আমরা মাছ, মাংস একদমই খাই না। যে সব মেয়েমানুষ বিয়ে হওয়ার আগেই অক্কা পায়, তারা এখানে এসে বিয়ে করতে চায় না। আমরা কোনও জোর জবরদস্তিও করি না। তারা মানানসই মানুষের খোঁজ পেলে তার ঘার মটকে, এখানে এনে, অমাবস্যার রাতে গায়ে গোবরের পর কচু-দেবতার সামনে তার সঙ্গে ঘেঁটুফুলের মালা বদল করে বিয়ে করে। মানুষেরা তাদের নাম দিয়েছে শাঁকচুন্নি। ঘর-গেরস্থালী করা বধূর এমন কুচ্ছিত নাম দেওয়া উচিত? আর ওই আপনারা কি কি যেন বলেন? ঝ্যাঁটায়-চড়া ডাইনী, উল্টো-পা পেত্নী, আরও কত কি। আমাদের রাজ্যে কেউ ঝ্যাঁটায় চড়ে উড়ে বেড়ায় না। ঝ্যাঁটা ব্যবহার হয় একমাত্র বিয়ের সময়। আর পেত্নীদের পা কখনও উল্টো হয় না। পা উল্টো হলে দুই নারকোল গাছের মাথায় দুই পা রেখে দাঁড়াতে অসুবিধা হতো না?

কচু-দেবতার কথা একটু বলে রাখি। বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আমরাও পূজা করি। পুরাতন মানকচুর গায়ে চামচিকের রক্ত দিয়ে তিলক কেটে তৈরি হয় আমাদের বিগ্রহ। কচি বিছুটি পাতার মালা পরিয়ে আমরা তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করি। আপনাদের তুলসী, আমাদের হোলো বিছুটি। যেদিন গোরস্থানের মাঠে ওই নতুন বিগ্রহ বসানো হয়, সেদিন আমরা সবাই দেহ ধারণ করি। ওই একদিনই আমাদের জামাকাপড় পরতে হয়। একবার একটা মানুষ আমাদের ওই কচু-দেবতার গায়ে পা দিয়েছিল। মরে গেলো পরের দিনই। আত্মহত্যা করলো। আত্মহত্যা করে যারা আমাদের এখানে আসে তাদের কোনও এক কচি মেছো-পেত্নীকে বিবাহ করতে হয়। আমরা অবশ্য আত্মহত্যা করি না। আমাদের হয় আত্ম-জাগরণ। প্রতি পঞ্চাশ বছর পর আমরা কচু-দেবতার সামনে জ্যান্ত চামচিকে বলি দিয়ে আমাদের দীর্ঘ আয়ু কামনা করি।

অমাবস্যার বিভীষিকা আমাদের এই সমাজের সবচেয়ে বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ভুত। বয়স দু হাজার পেরিয়ে গেছে। এখন সে অবসরপ্রাপ্ত। সে নাকি একবার নেপোলিয়নের তাবুতে ঢুকে তার লুঙ্গির খুঁট ধরে টেনেছিল। পরদিন নেপোলিয়ন ভয়ে যুদ্ধে যান নি। হাঁ, ভয় দেখাতেও সাহস লাগে। নেপোলিয়নের তাবুতে ঢোকা কি যে সে কথা? সে বলছে ভুতেদের খুব দুর্দিন আসছে। কারণ মানুষেরা নাকি অন্য গ্রহে বসবাসের ব্যবস্থা প্রায় পাকা করতে চলেছে। মানুষ না থাকলে কি আর ভুতেদের দিন চলবে?

Sunday, January 29, 2012

ভালবাসার অধিকার

বাড়ি ফিরে প্রনবেশ সুপর্ণার সঙ্গে দু একটা কথা বলে শুয়ে পড়লো। খুব ক্লান্ত লাগছিল। সুপর্ণাও ছেলেকে নিয়ে বিছানায় চলে গেল। চতুর্দিক কেমন যেন শূন্য মনে হচ্ছিল প্রনবেশের। ঘরের সবুজ আলোর বাতিটা আজ যেন খুব স্তিমিত মনে হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা আগে তারা দুজনে ছিল এক জমজমাট বিয়েবাড়ির মধ্যে। কত লোকই না ছিল সেখানে। আর এই মুহূর্তে সে ও সুপর্ণা একলা ঘরে বন্দী। দম বন্ধ হয়ে আসছিল প্রনবেশের। ঘুমও আসছে না। ঘুমিয়ে উঠলে নিশ্চয় সকালে বেশ কিছুটা সুস্থ বোধ হতো। ক্লান্তিটা নিতান্তই মনের। সুপর্ণা আজ অনেকদিন বাদে বেশ খুশী ছিল। সে ও শান্তনু দুজনেই বোধহয় ঘুমিয়ে পরেছে।

জয়তির কথা প্রনবেশ আজ যেন কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। একটা অপরাধী ভাব তার মনকে বারবার নাড়া দিচ্ছে। দীর্ঘ চোদ্দ বছর বাদে জয়তির সঙ্গে তার এইভাবে দেখা হবে প্রনবেশ কোনদিন ভাবেনি। সে ও জয়তি কলেজে একই সঙ্গে পড়তো। ঊনিশশো পঁচাশি সালের কথা। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর হৃদয়ের দেওয়া নেওয়া। উভয়ের প্রতি গভীর বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল খুব তাড়াতাড়িই। কলেজের পর কত বিকেল কেটেছে দুজনের একসাথে পথ চলতে চলতে। এক এক দিন দেরী হয়ে গেলে প্রনবেশ জয়তিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর বাড়ি ফিরত।

কলেজ পাশ করবার পরে প্রনবেশ এক সরকারি দপ্তরে চাকরিও পেয়ে যায়। জয়তি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোনও এক কোর্সে ভর্তি হয়।

এইভাবে বছর দুয়েক কেটে যায়। জয়তি এম এ পাশও করে যায়। কিন্তু তাদের বিয়েতে বাধ সাধলো প্রনবেশের মা। জয়তির বাবা ছিলেন না। জয়তি যখন পাঁচ বছরের, তখন সে তার বাবাকে হারায়। তার মা এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে জয়তিকে মানুষ করেন। আর্থিক সঙ্গতি তাঁর বিশেষ ছিল না।

প্রনবেশ তাঁর মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেনি। ভেবেছিল ধীরে ধীরে মা হয়ত নরম হয়ে মত দেবেন। তাই সে জয়তিকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। উত্তরে সারাজীবন অপেক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জয়তি।

কোনও এক সন্ধ্যাবেলায় দুজনে গঙ্গার পাড়ে বসেছিল। প্রনবেশ কথায় কথায় বলে, "আমার সবচেয়ে অমূল্য যা কিছু আছে তা চিরকাল তোমার জন্যই থাকবে জয়ী। থাকবে সে সবের ওপর তোমার সারা জীবনের অধিকার।" প্রনবেশের হাত দুটো ধরে জয়তি প্রশ্ন করেছিল, "মনে রাখবে তো?" প্রনবেশ উত্তর দিয়েছিল, "রাখবো।"

মার অবসরপ্রাপ্তির পর জয়তি ও তার মাকে কলকাতার বাড়ি ছেড়ে বর্ধমানে চলে যেতে হয়। জয়তি সেখানে এক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে কাজ পেয়ে যায়। এইখান থেকেই জয়তি ও প্রনবেশের যোগাযোগ একটু একটু করে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সারা সপ্তাহ অফিস করে প্রনবেশ সপ্তাহের শেষে প্রায়ই আর দেখা করতে যেতে পারতো না। টেলিফোনে দু জনের কিছু কথা হতো, তবে তা খুবই সামান্য। জয়তির বাড়িতে তখন টেলিফোন ছিল না। দু একবার জয়তি স্কুল ছুটি নিয়ে প্রনবেশের সঙ্গে অফিসে দেখা করতে এসেছিল। তবে জয়তির মা অসুস্থ হয়ে পরার পরে সেটাও আর সম্ভব হতো না।

বছর খানেকের মধ্যে প্রনবেশের মা প্রনবেশের বিয়ে ঠিক করলেন তাঁর নিজেরই এক বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে। প্রনবেশ অনেক চেষ্টা করেছিল বিয়েটা আটকাবার। শেষমেশ মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রনবেশকে মত দিতেই হোলো। হয়ে গেলো বিয়ে। জয়তি জানতে পারলো বিয়ের মাস খানেক পরে। আর সে গত চোদ্দ বছরে প্রনবেশের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও চেষ্টা করেনি।

তারপর আজ রাতে এক বিয়েবাড়িতে দুজনের অকস্মাৎ দেখা। জয়তি নিজেই এসে কথা বলে। তার চোখে মুখে আজ এক খুশীর জোয়ার দেখেছিল প্রনবেশ। সে বিয়ে করেনি। আর সেটাই প্রনবেশকে আজ রাতে এক অপরাধ বোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কই, জয়তি তো কোনও অনুযোগ করলো না। তারা দুজন তো অনেকক্ষণ একা কথা বলেছিল। সুপর্ণাও কাছাকাছি ছিল না। যাওয়ার আগে প্রনবেশের অফিসের ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর সে নিজেই চেয়ে নিয়ে যায়। বলে যায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে যোগাযোগ করবে।

এর পর কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। জয়তির সঙ্গে প্রনবেশের এর মধ্যে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। তার মা মারা গেছেন। সে এখন বর্ধমানে একাই থাকে। জয়তি অতীতের কোনও কথা একবারের জন্যও বলেনি। প্রনবেশ এতে আরও অবাক হতে থাকে। কেমন একটা অজানা আশঙ্কা তার মনে দানা বাঁধতে থাকে। আজকাল সে বাড়িতেও বিশেষ কথা বলে না। তা সুপর্ণার লক্ষ্য এড়ায় নি। প্রনবেশ অফিসের নানান ঝামেলার কথা বলে এড়িয়ে যেতে থাকে। ছেলে শান্তনুর সঙ্গে রাতে অফিস থেকে ফিরে প্রনবেশ অনেকটা সময় কাটাতো। আজকাল তাও প্রায় বন্ধ।

দিনটা ছিল রবিবার। জয়তির অনুরোধে তারা দুজন সেদিন বিকেলে গিয়েছিল সেই গঙ্গার পাড়ে। জয়তি ছিল সেদিন খুবই চুপচাপ। সন্ধ্যা নেমে আসছে গঙ্গার বুকে। ওপারে কল-কারখানার কিছু আলো জ্বলে উঠতে দেখা গেলো। আলো পড়ে গঙ্গার জলটা চিক্ চিক্ করছিল। জয়তির চোখ দুটোও তেমনই চি্ক চিক্ করে উঠলো। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে জয়তি বললো, "আজ যদি আমার অধিকারের থেকে এক কণামাত্র চাই, আমায় দেবে প্রনবেশ?" প্রনবেশের মনে একটা ধাক্কা লাগলো। কি চাইবে জয়তি। প্রনবেশ বলে, "আমি চেষ্টা করবো জয়ী, তুমি বলো।"
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে জয়তি বললো, "বাকি জীবনের বাঁচার কোনো অবলম্বন আমায় দেবে?"
"কি চাও বলো, জয়ী", প্রনবেশ উত্তর দেয়।
"আমাকে একটা সন্তান দেবে প্রনবেশ?" জয়ী খুব ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে। তার কণ্ঠে কোন জড়তা ছিল না।
"সুপর্ণার তো সব আছে। আমার কি আছে বলো?" জয়তি বলে চলে।
প্রনবেশের মাথাটা মুহূর্তের জন্য ঘুরে যায়। যে অধিকার জয়তিকে সে একদিন বিনা সর্তেই দিয়েছিল, তার কথা প্রনবেশের মনে পড়ে যায়। এমনভাবে কোনও মেয়ে তার অধিকার চাইতে পারে? কে যেন তার ভিতর থেকে বলে উঠলো, "পারে, প্রনবেশ পারে। সত্যিকারের ভালবাসলেই পারে। ভালবাসার অধিকার যে সবার ওপরে।"
তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে প্রনবেশ বলে, "তুমি সত্যি চাও, জয়ী? তাহলে দেবো।"
এর পর সেদিন আর বিশেষ কথা হয়ে নি দুজনের।

দু বছর পরের কথা। জয়তি বর্ধমানে আর থাকে না। স্কুলের কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে প্রনবেশের ছয় মাস বয়সের পুত্র সন্তান। প্রনবেশের তাকে খুঁজে পাওয়ার আর কোন উপায় রইল না। জয়তি জানতো প্রনবেশ নিজের সন্তানকে ভুলতে পারবে না। সুপর্ণার জীবন সে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দিতে চায়ে নি। তাই সে ছেলেকে নিয়ে প্রনবেশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলো। প্রনবেশ যাতে আর কোনদিন তার ও তার ছেলের খোঁজ না পায়।


- ফেব্রুয়ারী, ২০০৪

Thursday, January 26, 2012

স্মৃতি রয়ে যায়

প্রথম পরিচয়ের পর কম্পিউটার নামক যন্ত্রটার সঙ্গে অয়নের অনেক বছর কেটে গেছে সেই ঊনিশশো সাতাশি সাল থেকে ঊনিশশো নিরানব্বই প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার ওই নিরানব্বই সাল থেকেই অয়নের বয়েস তখন ঊনচল্লিশ পেরিয়ে চল্লিশের কোঠায়ে তখন বিশেষ ভালো সামাজিক যোগাযোগের ব্যবস্থা ইন্টারনেটে ছিল না ই-মেলএর মাধ্যমে কিছু যোগাযোগ করা যেত আর ছিল সরাসরি কিছু কথা বলার ব্যবস্থা, যেটাকে ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং বলে মাস-খানেক ব্যবহার করার পরই ইন্টারনেটে অয়নের চার, পাঁচজন বন্ধু জুটে গেল খুব মজা লাগতো অয়নের তাদের সঙ্গে চিঠি আদান প্রদান করতে এদের সবাইই ছিল বিদেশী কেউই ভারতীয় নয় বন্ধুর সংখ্যা আস্তে আস্তে দশ বারোতে গিয়ে ঠেকলো

আজকে, অর্থাৎ দু হাজার বারো সালে, তাদের দুজনের সঙ্গে অয়নের এখনও যোগাযোগ আছে কাজের ব্যাপারে যোগাযোগ দিয়ে শুরু করে একজনের সঙ্গে অয়নের বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তার নাম কাথেরিন তার তখন প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের কর্মী ছিল সে তা ছাড়াও এক নামকরা আন্তর্জাতিক সামাজিক সংস্থার তৎপর সদস্য ছিল তার আরও একটা পরিচয় ছিল এক নামকরা ইংরাজ লেখকের বংশধর ছিল কাথেরিন উচ্চ বংশের উচ্চ সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় অয়ন পরে অনেকবার পেয়েছে

প্রথমে কয়েকবার কাথেরিনের সাথে ই-মেল আদান প্রদানের পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়

আবার যোগাযোগ বছর খানেক বাদে দুহাজার এক সালে ভারতের গুজরাটে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় বহু লোক মারা যায় খবরের কাগজে সেই খবর দেখে কাথেরিন অয়নকে চিঠি লেখে জানবার জন্য যে সে ঠিক আছে কিনা এবং ভূমিকম্পের জায়গা থেকে অয়নের বাসস্থান কত দূরে বলে রাখি, অয়ন ছিল দিল্লীর বাসিন্দা এমন একটা চিঠি পেয়ে অয়ন খুব অবাক হয়েছিল, আবার ভালও লেগেছিল যে এতদিন বাদে এমনই এক কারণে কেউ তার খোঁজ করছে যাকে সে ভুলেই গিয়েছিল যাই হোক, এর পর থেকে অয়ন ও কাথেরিনের প্রায়ই চিঠি বিনিময় হতো অয়ন কাথেরিনের দেশের অনেক নতুন তথ্য জানতে পারে তার চিঠি থেকে যেমন বরফে ঢাকা কাথেরিনের দেশে তাদের বাড়িগুলো মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচু করে বানানো হয় কাঠের পাটাতনের উপর তাতে নীচের ঠাণ্ডাটা আটকানো যায় রাত্রে ওই পাটাতনের নীচে হরিণজাতীয় এক প্রাণী এসে শুয়ে থাকে এমনই আরও কত তথ্য কাথেরিনের দেশের খুব সুন্দর, সুন্দর ছবিও সে পাঠাতো অয়নের এসব জানতে ও দেখতে বেশ ভালই লাগতো অয়নের স্ত্রী মধুমিতা ও পুত্র অনির্বাণও সে সব ছবি দেখে বেশ আনন্দ পেতো এই সূত্রে কাথেরিনের স্বামী টমাসের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে যায় অয়নের

একবার পড়ে গিয়ে কাথেরিনের হাতের হার ভেঙ্গে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন কম্পিউটার ব্যবহার করতে খুব অসুবিধা হয়েছিল হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা একটা ছবিও পাঠিয়েছিল অয়নকে


দুহাজার এক সালের ডিসেম্বর মাস কাথেরিন লিখলো অয়নকে, তারা, অর্থাৎ সে ও তার স্বামী টমাস, কিছুদিনের জন্য পাশেরই এক ছোট্ট দেশে সাতদিনের জন্য বেড়াতে যাবে অনেকদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি খুবই আনন্দিত লাগলো কাথেরিনকে তার চিঠিতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য সে কেনাকাটা করছিল খুবই আনন্দের সঙ্গে আরও লিখলো যে ফিরে এসে সে ভারতে যাবে কিছুদিনের জন্য, ওই সামাজিক সংস্থার কিছু কাজে জানতে চাইলো ভারতে বাঙ্গালোর শহর থেকে দিল্লী কতদূর

তারিখটা ডিসেম্বর কুড়ি, দু হাজার এক অয়ন কাথেরিনের একটা ই-মেল পেলো তাতে কাথেরিন লিখেছে সে খুব আনন্দের সঙ্গে বেড়াচ্ছে কয়েক দিনের বাদে সে আবার যোগাযোগ করবে তবে কম্পিউটারে স্প্যানিশ কিবোর্ড হওয়ায় টাইপ করতে বেশ একটু অসুবিধা হচ্ছে

অয়ন তারপর কিছুদিন আর কাথেরিনের কোনও চিঠি পায়নি খ্রিস্টমাস ও নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে অয়ন একটা ই-মেল পাঠিয়েছিল কোনও উত্তর পায়নি অয়ন ভেবেছিল কাথেরিন নিশ্চয় বেড়াতে ব্যস্ত

তারিখটা জানুয়ারি ছয়, দু হাজার দুই অয়ন সেদিন রাতে ই-মেল পেলো একটা না, কাথেরিনের লেখা নয় তার স্বামী টমাসের লেখা কাথেরিনের মৃত্যুসংবাদ ছিল সেটা স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে জলের চাপ সহ্য করতে না পারায়ে তার মৃত্যু হয়, ডিসেম্বরের ছাব্বিশ তারিখে বাঙ্গালোরে তার আর আসা হলো না

শোক জ্ঞাপন করে অনেক কষ্ট করে অয়ন একটা উত্তর দিয়েছিল টমাসকে বলেছিল সম্ভব হলে যোগাযোগ রাখতে তবে টমাস তা বেশিদিন পারেনি

আজও কখনও, কখনও কাথেরিনের কথা অয়নের মনে হয় মাত্র দেড় বছরের বন্ধুত্ব তখন চোখ দুটো তার জলে ভরে ওঠে বন্ধু হিসাবে এবং তারও ওপরে মানুষ হিসাবে কাথেরিন যেন প্রয়োজনের থেকে একটু বেশীই উদার ছিল তাই হয়ত তাকে হারাতে হয়েছিল অয়নের


- সত্য ঘটনা অবলম্বনে

Monday, January 23, 2012

জোনাকি

ল্যাম্পপোস্টের আলোটা আজ কোনও কারণে জ্বলছে না। তারই নীচে জোনাকি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। এর আগেও সে এই ল্যাম্পপোস্টটার নীচে অনেক বিকেলে অপেক্ষা করেছে। আজকের অপেক্ষাটা একটু অন্যরকমের। মনের আনন্দটা আজ বেশ কিছুটাই আলাদা। দিনের শেষ আলোটুকুও ফুরিয়ে এলো। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরছে। ছাতায়ে বৃষ্টির জলের থেকে মাথাটা আটকাচ্ছে বটে, তবে শাড়ির নীচের দিকটা ভিজেই চলেছে। দু একজন পথচারী সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেও। একা সন্ধ্যাবেলা একটি মেয়েকে রাস্তায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে মানুষ একটু কৌতূহল তো দেখাবেই। এই জন্যই রাজর্ষিকে বারবার বলেছিল জোনাকি, "তুমি কিন্তু দেরি কোরো না।" রাজর্ষি কোনদিন তো এমন দেরি করে না। আর আজ এই বিশেষ দিনে তার কি হল? ভেবে পায় না জোনাকি। রাস্তার পাশেই একটা বাগানঘেরা বাড়ির দেয়ালের ধারে একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছের ডাল ফুটপাথের ওপর এসে পরেছে। একবার ভেবেছিল একটা ফুল নিয়ে মাথায় লাগাবে। তারপরই তার মনে হল, না থাক, রাজর্ষি আসুক। ওকেই বলবে লাগিয়ে দিতে।

চলন্ত গাড়িগুলোর হেডলাইটএর আলো ক্ষণিকের জন্য তার সর্বাঙ্গ আলোকিত করে আবার তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অসহ্য এই গাড়ির আলোগুলো। ভাবে জোনাকি। আর কতক্ষণ এভাবে সে দাঁড়িয়ে থাকবে?

একজন রিকশাওয়ালা সামানে এসে জিজ্ঞাসা করলো, "দিদিমণি যাবেন?" তাকে না বলে দিল জোনাকি। ঘড়িতে সময় তখন সাতটা পেরিয়ে গেছে।

আরও কতক্ষণ সে দাঁড়িয়েছিল ল্যাম্পপোস্টের নীচে তা মনে নেই। আর সে ঘড়ি দেখেনি। রাস্তাটা ফাঁকা হয়ে আসছে। উল্টোদিকের দোকানগুলোও একটা দুটো করে বন্ধ হচ্ছে। এক একটা গাড়িও এখন আসছে অনেক দেরিতে।

কত কথা মনে পড়ে জোনাকির। রাজর্ষির সঙ্গে আলাপ দু বছর আগে। সালটা ছিল ঊনিশশো আটাত্তর। যেবার জোনাকি বিএ পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দেয়। তার দু বছর আগে মাকে হারায় জোনাকি। হঠাৎ এই মুহূর্তে মার কথা তার খুব মনে পরছে। আর কিছু মনে পরে না জোনাকির। মাথাটা কেমন যেন অস্থির লাগছে। বাবাকে গিয়ে কি বলবে সে বুঝতে পারে না। আজ ছিল বাবার সঙ্গে রাজর্ষির প্রথম আলাপের দিন। এক পা দু পা করে কখন যে সে বাস স্টপে এসে দাঁড়ায় তা তার মনে নেই। তারপর বাস ধরে বাড়ি। বাড়ি ফিরে রাজর্ষিকে ফোন করবার চেষ্টা করে জোনাকি। কিন্তু তাকে বাড়িতে পায়নি। রাজর্ষির মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে কোনও বিশেষ কাজে সে বেরিয়ে গেছে। ফিরতে রাত হবে। এর পর একটু রাতে জোনাকি আবার ফোন করে। কেউ ফোন ধরেনি। বাবা কোনও প্রশ্ন করে জোনাকিকে বিব্রত করেন নি। মেয়ে তার বড় আদরের।

দু দিন বাদে রাজর্ষির অফিস থেকে জোনাকি জানতে পারে রাজর্ষি বাঙ্গালোরে বদলি হয়ে গেছে। ওর মা তো আমায় কিছু বললেন না এই বিষয়ে সেদিন রাতে। ভাবে জোনাকি।

মাস ছয়েক বাদে সকল অপেক্ষার অবসান ঘটলো যেদিন জোনাকি হাতে পেল রঞ্জনার বিবাহের নিমন্ত্রণ পত্র

পাত্রের নাম রাজর্ষি মল্লিক। হঠাৎই জোনাকির মনে পড়ে রঞ্জনার বাবা বাঙ্গালোরে রাজর্ষির কোম্পানিতেই খুব বড় অফিসার না? তাই তো। একটা কথাই জোনাকির শুধু মনে হল। যাওয়ার সময় রাজর্ষি একবার তাকে বলে গেলো না?

গিয়েছিল জোনাকি রঞ্জনার বিয়েতে, শেষ বিদায়ের বেদনাটুকু সকল মন প্রাণ ভরে নিয়ে আসতে। হয়ত বা বাকি জীবনের পাথেয়টুকু অর্জন করে আনতে। মেয়েরা যে জীবনে একবারই ভালোবাসে।


- চন্দ্রভানু গুপ্ত, ফেব্রুয়ারী, ২০০৫

Sunday, January 22, 2012

আগুয়ান প্রতিবেশী

মোদের পাড়াতে এক
প্রতিবেশী লোক,
দেখা হইলেই গায়ে পড়িয়া
কথা বলার ঝোঁক

অগত্যা বাধ্য হইয়া
কথা কইতে হয়,
দ্বিতীয় দিনেই মনে জাগে
ভীষণরকম ভয়

মুখোমুখি বাক্যালাপ
ভয়টা আবার কিসে,
কথা কইতে কইতে
সে যে আগাইয়া আসে

আমি পিছাই এক পা, দু পা
কোনও উপায় নাই,
আমি পিছাইলেও তার
আগানো থামে কই

তার গরম নিশ্বাস মোর
মুখের ওপর পড়ে,
ভয় হয় এবার বুঝি
জাপটাইয়া ধরে

পুরুষ না হইয়া যদি
মহিলা কোনও হয়,
পথের মাঝে বাধিবে এক
গোলমাল নিশ্চয়

এখন তাকে দেখিলেই
থাকি দূরে দূরে,
বাড়ি ফিরি অন্য রাস্তা
দিয়ে ঘুরে ঘুরে

জানিনা তার বাড়ির লোক
কি করে উপায়,
জগতে যে কতরকম
বিচিত্র মানুষ হয়।।

- চন্দ্রভানু গুপ্ত

Friday, January 20, 2012

কেমন করে ছাড়ি

ছেড়ে দেবো পদ্য লেখা,
অনেক দিনের সাধনা,
যখন তখন ব্যঙ্গ করা,
কক্ষনো তা সয় না।
ছাড়তে আমি পারবো না যে,
মানবে না তো মন,
লেখা ছেড়ে দিলে আমায়,
ছাড়বে পাঠকগণ?


- চন্দ্রভানু গুপ্ত, জানুয়ারী, ২০১২

বেগুনভাজা

এক যে ছিল রাজা,
সে খেত বেগুন ভাজা।
বেগুনে ছিল পোকা,
খেয়ে রাজা হলেন বোকা।
রাজার বাড়ির বামুন ঠাকুর,
খায় সুধু সে সিদ্ধ কাঁকুড়।
খাইয়ে তাকে বেগুন ভাজা,
বলেন রাজা, "বাড়ি যা সোজা,
এদিকমুখো হলে আবার,
এক কোপেতে করবো সাবাড়"।


- চন্দ্রভানু গুপ্ত, মার্চ, ২০০৪

Thursday, January 19, 2012

চৈতন্য

আমরা প্রতিদিন ধরে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ইতিহাস রচনা করি। আজকের দিনে বসে যা করি তারই প্রতিফলন তো আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাই। তাই আজ যেন আমি সঠিক পথে চলি, সঠিক কাজ করি। তবেই তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা এক উজ্জ্বল পৃথিবী রেখে যেতে পারবো। আর তা যদি না পারি তো আমাদের জীবনটাই বৃথা গেলো। ভোগ করে, আনন্দ করে যা পেয়ে গেলাম, তাতে আমি খুশী হলাম বটে, কিন্তু আমার এত বৎসরের লালিত, পালিত এত প্রিয় মানবজন্ম পরমব্রহ্মের চোখে এক আগাছা স্বরূপ প্রতীয়মান হলো।

স্বাধীনতার সুখ ভোগ করে বহু বছর কেটে গেল। এবার ওঠো, জাগো, চারিদিকে তাকাও। কঠোর, সংগ্রামী মন নিয়ে যে যার কাজে লেগে পরো। আর কতদিন নিজের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে কাটাবে? আজ তুমি নিজের ঘরের মধ্যে নিজের সকল সমাজ তথা অন্য সকল চেতনাকে আবদ্ধ করে রেখেছো। কাল তোমার সন্তান স্থান নেবে তোমার বা তার নিজের বাড়ির অন্ধকার চোরাকুঠুরিতে। এতটুকু আলো, একটুখানি বাতাসের জন্য হাহাকার করবে সে। তার জন্য এই দিনলিপি লিখে রেখে যেয়ো না। তার জন্য মুক্ত আকাশের নীচে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়ার স্বাধীনতাটুকু নিশ্চিত করে রেখে যাও।

তাকে বৃহত্তর সমাজের অংশ করে গড়ে তোলো। নিজের প্রতিবেশীকে ভালবাসতে শেখাও। দরিদ্রের সেবা করতে শেখাও। তাকে বস্তুতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে মুক্ত করে, বর্তমান জগতের হাজার, হাজার অপ্রয়োজনীয় প্রলোভন থেকে মুক্ত করে তাকে শিখিয়ে যাও বাঁচার অর্থ কি। জাগিয়ে তুলো তার মধ্যে কিছুটা
আধ্যাত্মচেতনা। তবেই সে নিজেকে জানতে, বুঝতে শিখবে, নিজেকে মেলে ধরতে শিখবে। তাকে শিখিয়ে যেয়ো যে নিজেও যেমন বাঁচবে, ভোগ করবে, আবার চারপাশের সবাইকেও বাঁচতে সাহায্য করবে, যতটা সম্ভব, সামান্য কিছু ত্যাগের বিনিময়ে। এতেই মানবজীবন, তথা মানব-সংসারের সার্থকতা। পরমব্রহ্মকে জানতে পারলে, তাঁকে স্মরণ করতে পারলে আর কোনও অসুবিধাই থাকে না, কোনও বাধাই বাধা থাকে না। এর মধ্য দিয়েই আমরা সবাই মনুষ্যত্বের জয়গান করতে পারি। এই পৃথিবীতে এইভাবেই একদিন স্বর্গরাজ্য স্থাপিত হবে।
ওঁ নমঃ শিবায়ঃ।

চন্দ্রভানু গুপ্ত, জুলাই ২০০৪

নাইট ক্লাব

গন্ধটা প্লেটে ভরা খাবার,
প্রসাধনী সুগন্ধ,
চোখ ঝলসানো রঙ্গীন পোশাক,
আর দম বন্ধ করা হাহাকার মেশানো।
চারিদিকে ধূসর গুঞ্জনধনি,
হঠাৎ চাপা পরে যায়
মায়াবী হাসির মুখরতায়।
ধোঁয়ার প্রতিরোধ ভেদ করে,
কানে আসে অচেনা শিল্পীর
অস্পষ্ট সঙ্গীত।
সুরার মত্ততা এখনও
উন্মাদনার চেহারা ধরে নি।
মৃদু আলোয় রচনা হয়েছে
এক মনোরম নারকীয় পরিবেশ।
এ মানুষগুলো কারা?
এদের কি গৃহ নেই?


- চন্দ্রভানু গুপ্ত, এপ্রিল, ২০০৭

Wednesday, January 18, 2012

রাত্রিকাল

কম্পিউটারের ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরছে। আমার বাড়ির ঠিক সামনে একটা বেলগাছ আছে। বেলগাছের পাতার থেকে জল ঝরে পরছে, অথবা বলতে পারি বেয়ে নামছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো জলে ভেজা পাতার ওপর পরে এতটাই ঝকমক্ করছে যে দেখে মনে হচ্ছে হাজার বাতি দিয়ে গাছটাকে যেন সাজানো হয়েছে। একটু দূরে একটা সুপারি গাছ আছে। অন্ধকার আকাশের প্রেক্ষাপটে উচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির মেঘ আকাশে থাকলে আকাশটাকে গাঢ় নীলাভের চেয়ে বেশ খানিকটা লালচে বলেই মনে হয়। রাত্রিকাল যে এত সুন্দর, মনোরম ও স্বপ্নময় তা এত নিবীড় ভাবে আগে কখনো প্রত্যক্ষ বা অনুভব করিনি। অথচ খুব কম লোকই এই সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করবার জন্য জেগে থাকে।

এই সময়ে পৃথিবীর প্রায় অর্ধভাগ নিদ্রিত অবস্থায় নিশ্চুপ। রাতের নীরবতা কোনও এক প্রতিবেশীর ছাদ থেকে জমে থাকা জল পরার শব্দে প্রতি মুহূর্তে ভঙ্গ হচ্ছে। কিন্তু রাতকে যেমন নীরব মনে হয় সে কি সত্যিই তেমন নীরব? হয়ত নয়। নীরব রাত্রিকাল কোলাহলমুখর দিনের চেয়ে অনেক বেশি সচল এবং প্রাণবন্ত। রাতের নীরবতার মধ্যে যে প্রাকৃতিক সামঞ্জস্য আছে তা মানসচক্ষু দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। দিনের বেলায় এই সামঞ্জস্য খুব বড় একটা লক্ষ্য করা যায় না। যা কিছু বৃদ্ধি পায় তা কেবলই রাতের বেলায়। দিনের বেলায় এই পৃথিবী একান্তই আমাদের। তখন আমাদের প্রয়োজন মত এই পৃথিবীকে আমরা ব্যবহার করি। রাতে আমরা হয়ে যাই এই পৃথিবীর। কারণ রাত্রিকালেই আমরা নিজেদের সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক চেতনার মধ্যে ফিরে পাই, এবং আমাদের সমস্ত ইচ্ছাগুলি মনের উপরিভাগে উঠে আসে। রাতে আমরা একটু পিছনদিকে ফেরবার প্রবনতা পোষণ করি। দিনের বেলা আমরা যে জগতে বিচরণ করি তার
অনেকটাই বস্তুতান্ত্রিক । মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকি। রাতে আমরা স্বার্থহীন, পরোপকারী, দয়ালু হয়ে উঠি। দিনে এই চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলি তেমন ভালভাবে লক্ষ্য করা যায় না

রাতের আঁধার আমাদের আধ্যাত্মচেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। দিনের বেলায় আমরা যে ধাপে ধাপে নিজেদের হারাতে থাকি তা কেবল রাতের বেলায় নতুন এক আলোয় নিজেদের খুঁজে পাওয়ার জন্যই। তাই তো রাত আমাদের অনেকভাবে সমৃদ্ধ করে তোলে। রাতের নিজস্ব একটা একাকীত্ববোধ আছে। এই একাকীত্ববোধের জন্যই আমরা আবার নিজেদের মধ্যে নিজেদের আত্মাকে খুঁজে পাই। একমাত্র রাতে বেলাতেই আমরা দূর আকাশের তারা ও চাঁদের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। মন যতদূর খুশী তার পরিধি বিস্তার করতে পারে। চাঁদের স্বপ্নময়তা আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারি যখন একটি পূর্ণচন্দ্র ও একফালি বাঁকা চন্দ্র তাদের সতন্ত্র, প্রছন্ন এবং আলাদা, আলাদা প্রভাব আমাদের মনের ওপর বিস্তার করে। পূর্ণচন্দ্র আমাদের মনকে প্রেমে ভরিয়ে তোলে। আর একফালি বাঁকা চন্দ্র আমাদের মনে আনে এক বিষাদের সুর। রাতের অন্ধকার আমাদের কাছে দিনের আলোকময়তার চেয়ে অনেক বেশী আপন করে ধরা দেয়। অন্ধকার আমাদের মানসচক্ষুর সামনে অনেক বেশী কিছু উপস্থাপন করে যা দিনের উজ্জ্বল আলো কখনই পারে না। তা আমাদের মনে এক প্রসন্ন, চিরস্থায়ী প্রভাব এনে দেয়। রাত বারংবার আমাদের জীবনের পথ চলার জন্য তৈরি করে দেয়। আমরা কোনও এক পরমাত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে শান্তি পাই, যা আমাদের আবার সজীব করে তোলে। তাই বলি, যে রাতের অন্ধকার উপভোগ করে তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না, সে ভোরের আলোও ঠিকভাবে দেখতে পায় না।


- চন্দ্রভানু গুপ্ত, অগাস্ট ৭, ২০১১

Tuesday, January 17, 2012

ব্যাঙ, ঝি ঝি পোকা, ইঁদুর, প্যাঁচা ও প্রেম

চাঁদের আলো পরেছে তোমার এলো চুলে ভারি সুন্দর যে শব্দটা শুনতে পাচ্ছ ওটা ব্যাঙের ডাক থেমে যাবে কিছুক্ষণ বাদে ওতে প্রেমের কোনও ব্যাঘাত ঘটে না ওটাও প্রেমেরই ডাক দূরে মাঠের প্রান্তে আন্ধকারটা বড্ড বেশী সুধু একটা তালগাছ মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে আকাশের প্রেক্ষাপটে তালগাছটা বড্ড একা তাই নয় কি? প্রেমের গান তুমি গাইতে পারো না তা আমি অনেকদিন আগেই জেনেছি তাতে কিছু আসে যায় না তুমি নীরব থেকেই অনেক কিছু বলে ফেলো আমিও শুনি নীরবে দেখো, এই নীরবতা যেন কোনদিন ভঙ্গ না হয় ঝি ঝি পোকার ডাকটা আর শুনতে পাচ্ছি না বোধহয় ব্যাঙটা ওকে খেয়ে ফেলেছে ব্যাঙ ঝি ঝি পোকা খায় কি? জানি না তবে দুর্ভিক্ষের সময় নিশ্চয় খায় ব্যাঙ আর ঝি ঝি পোকা, কোনোটাই দিনে ডাকে না আমি তো শুনিনি এরই সঙ্গে মনে পরলো প্যাঁচার কথা ওরাও বিচরণ করে সুধুমাত্র রাতের বেলায় ইঁদুর ধরতে প্রেম জমাতে এদের কোনও জুরি নেই

চাঁদটা চলে গেলো মেঘের আড়ালে গাঢ় হলো অন্ধকার এই অন্ধকারে তোমার অস্তিত্ব অনুভব করে নিজেকে বেশ মস্ত কেউ একটা মনে হচ্ছে দিনের আলোয় এমনটা কখনও হয় না দিনটা কেজো লোকেদের জন্য আর রাতটা যত বাউন্ডুলে অকাজের লোকেদের বিচরণ ক্ষেত্র যখন আর কোনও কিছু ভালো লাগে না তখন তোমার সান্নিধ্যই পেতে ইচ্ছা হয় তাতে নতুন করে ভালোলাগার জন্ম হয় চাঁদেরও ঠিক এমনটাই হয় ওরও মেঘের সাথে যত লুকোচুরি খেলা যা বললাম এতক্ষণ, বাস্তবের সাথে বোধহয় এর কোনও মিল নেই সুধুমাত্র প্যাঁচার ইঁদুর ধরা ছাড়া বেচারা ইঁদুর রাতের অন্ধকারেও রেহাই নেই একবার এক ইদুর তাই ছন্দ মিলিয়ে দু চার পঙক্তি লিখেছিল

"দিনে কাক, রাতে প্যাঁচা,
সাঙ্গ হবে আমার বাঁচা,
মানুষ তার সঙ্গে জুটে
দেখলেই মারে লাঠির খোঁচা"

কে যেন কবে একটা নাটক লিখেছিলেন নাম দিয়েছিলেন 'মরবে ইঁদুর বেচারা' নাটকটা পড়ে দেখিনি কখনও তবে ইঁদুরের দুর্গতির কথা বেশ অনুমান করতে পারছি যাই হোক, এ প্রবন্ধের যবনিকা পাত এখানেই হওয়া উচিত নয়ত পাঠক পাঠিকাদের হাতে খুব শীঘ্রই আমারও ইঁদুরের দশা হবে

ক্ষেত্রমোহন এসো

ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
তোমায় দেখে মোর,
ঘুম আসেনি দুই চোখেতে
রাত হয়েছে ভোর।
ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
তোমায় ভালবাসি,
তোমায় দেখলে পায় আমার
মুচকি, মুচকি হাসি।
ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
আমবাগানে এসো,
দেখা হলে আমায় কিন্তু
একটু ভালবেসো।
ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
আমার রঙ কালো,
কিন্তু তবু দেখতে আমায়
প্যাঁচার চেয়ে ভালো।
ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
আমি একটু ট্যারা,
তবে মাথায় অনেক চুল
নইকো আমি ন্যাড়া।
ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
তুমি বড় ভালো,
তোমায় দেওয়ার মতো আমার
আছে কি আর বলো।
ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
এসো তুমি কাছে,
তোমায় দেওয়ার মতো আমার
কিছু নিশ্চয় আছে।
ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
তোমার বাড়ি যাবো,
তোমার সিন্দুর মাথায়ে পরে
তবেই শান্তি পাবো।
ক্ষেত্রমোহন, ক্ষেত্রমোহন
দেখো একদিন ঠিক,
তোমার ছেলে আমার কোলে
হাসবে ফিক্ ফিক্।।

Monday, January 16, 2012

সহজ কথায় দর্শন

রামধনু রং গায়ে মাখবো বলে,
গিয়েছিলেম নীল আকাশের কোলে,
গিয়ে দেখি চারদিক সব ফাঁকা,
বুঝলাম আমি নিতান্তই বোকা
ধরায়ে ফিরে দেখি সবুজ ঘাসে,
আমায় দেখে গঙ্গাফরিং হাসে,
হয়ত বা রঙ লেগেছিল গায়ে,
চোখ দিয়ে কি সকল দেখা যায়?
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...