মোটেই বাজে বকবক করিতে বসি নাই। আমার বিস্তর কাজ আছে। ছবি আঁকি, গল্প, কবিতা লিখি, আবার কখনও, কখনও অর্থনীতির ও আধ্যাত্মিকতার চর্চা করিয়া থাকি। ছবি আঁকা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। রঙ, তুলি, কাগজ, পেন্সিল, তেল, জল, কত কি লাগে। তবে দেখিবেন, আমি যে এ কথা বলিলাম তা আবার ওই ওপরওয়ালাকে জানাইবেন না। আসলে আমাকে সকল রকম কাজ করিতে সেই তো সাহায্য করে। সে শুনিলে রাগ করিতে পারে। না হইলে আমি তো একটা পয়লা নম্বরের অকেজো মানুষ। তাই মান, মর্যাদা বিশেষ পাই না। দিনের বেশির ভাগ সময়েই আকাশ দেখি, তারা গুনি, গাছের পাতা গুনি, পাখি দেখি, গান শুনি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আপনি আবার এইসব অকেজো মানুষদের গুণগুলি রপ্ত করিবেন না যেন। তবেই সর্বনাশ!
তবে এই জীবন নামক বস্তুটাকে একেবারে উপেক্ষা করতে পারি না। জীবন, জীবিকা, প্রাণ, আত্মা, কর্ম, মায়া, এগুলির সবকয়টিয়ই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। আলোচনার মাঝে এগুলির কথা সবাই বারবার বলে। জন্মের পর হইতে বহু বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। কিন্তু আজও জীবন নামক বস্তুটি যে কি তাহা বুঝিলাম না। বনে, জঙ্গলে, পাহাড় পর্বতের আশেপাশে অনেক খুঁজিয়াছি, বুঝিলেন। পাই নাই। তাকে সামনে পাইলে জিজ্ঞাসা করিতাম, আচ্ছা মশাই, আমার রক্তমাংস-অস্থিপূর্ণ শরীরে আত্মা নামক কি একটা গুঁজিয়া দিয়া, আমার মধ্যে পরস্পরবিরোধী কতগুলি ইচ্ছার সঞ্চার করিয়া এবং হাত, পা ছুঁড়িতে শিখাইয়া সেই যে অদৃশ্য হইলেন, আর তো আপনার দেখা পাইলাম না। পড়ে অবশ্য হাঁটিতে শিখিয়াছি, এবং তার সঙ্গে আরও কত কি শিখিয়াছি। কিন্তু উদর ভরিবার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করিলে হইত না? ওই ব্যবস্থাটি বরাবরই বড় কাঁচা রহিয়া গেলো। অতীতে না জানিয়া, বিষাক্ত ফল খাইয়া কত লোকের মৃত্যু হইল। এক্ষণে অবশ্য আর এমনটা ঘটে না। আসল কথা জীবন আমাদিগের একান্ত আপনার, খুবই কাছের। তাহাকে আমরা বৃথাই দূর, দূরান্তে খুঁজিয়া মরি। তাহাকে চিনিবার, জানিবার ব্যবস্থা আমাদের অন্তরেই রহিয়াছে। ওই যে আত্মা নামক বস্তুটি, যার মৃত্যু নাই, বিনাশ নাই, যাহাকে আমরা কখনও, কখনও প্রাণও বলিয়া থাকি, সেই সব বলিয়া দেয়, সকল কিছুর খোঁজ দেয়। আত্মার ডাকে সারা দিবার অভ্যাস একবার রপ্ত করিতে পারিলে জীবনকে সঠিক পথে চালাইবার নিয়মগুলি সবই জানা হইয়া যায়।
আত্মার ডাকে সাড়া দিতে বাধ সাধে আমাদের 'আমি'-টি। আমি ও আমার, এই করিয়াই আমরা সারা জীবন কাটাইয়া দেই, আত্মার দিকে একবার ফিরিয়াও তাকাই না। সে বেচারা অন্ধকারে বসিয়া গুমরাইয়া কাঁদে। 'আমি' বস্তুটির প্রয়োজন হইল সে আহরণ করে। আহরিত বস্তুগুলির উপর মালিকানার সীলমোহর লাগায়। তবে বস্তুর উপর তার অধিকার জন্মায়। আহরিত বস্তু জ্ঞানও হইতে পারে। ওই আহরিত বস্তুগুলির কিছু দিয়া জীবিকার কাজ বেশ চলিয়া যায়। এবার প্রশ্ন হইল, অধিকার কেন? কোনও কিছুর উপর অধিকার না থাকিলে তো তা দান করা যায় না। আবার দান কেন? এই তো বেশ আহরণ, মালিকানা ইত্যাদি লইয়া সুখের কথা হইতেছিল। দানের প্রয়োজন ওই আত্মার ক্রন্দন বন্ধ করিবার জন্য। সে যে একমাত্র দানেই তুষ্ট, দানেই শুদ্ধ। অতএব আহরণ ও দান, এই দুইয়েরই প্রয়োজন আছে। কর্মের মাধ্যমে হয় আহরণ, উৎসবের দিনে হয় দান। এরই মধ্য দিয়া জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়।
এবার বলি, অতীতে যে কয়জন মানুষকে এই কথা কহিয়াছি, তাহারা এক্ষণে আমাকে এড়াইয়া চলে, আমার সামনে বেশীক্ষণ বসে না। আপনারাও কি ভবিষ্যতে উহাদের মত আমার নিকট হইতে পলায়ন করিবেন?
Tweet
No comments:
Post a Comment
অনুগ্রহ করে আপনার ব্ক্তব্য এইখানে অবশ্যই লিখুন......