"পাঠক,পাঠিকাদের মতামত বা মন্তব্যই তো লেখকদের লেখিকাদের পুনরায় লিখিবার একমাত্র প্রেরণা। তাই দয়া করিয়া মতামত দিতে ভুলিবেন না, তা সে যেমনই হউক না কেন ।" http://tobey-shono.blogspot.com

Monday, February 6, 2012

একটি ভুতের জবানবন্দী

কি আর বলব আপনাকে? ভুত সমাজে আর মান সম্মান থাকবে না আমাদের। মানুষগুলো কি ভয়ানক বেড়ে উঠেছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমরা ভুত, ভয় দেখানো আমাদের বহু প্রাচীন পেশা। প্রাগৈতিহাসিক যুগেও ভুত ছিল। আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আমাদের সমাজে ভয় দেখানোর ক্ষমতাটা সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ছারপত্র। আমাদের বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে গেলে আগেই দেখে বাচ্চার বাবা এযাবৎ কয়টা ভুতুড়ে বাড়িতে থেকে কতজন মানুষকে ভয় দেখিয়েছে। কি ভাবছেন? সব হিসেব রাখতে হয় আমাদের। আপনাদের মত আমাদের বায়েও-ডেটা হয় না। ওটা খুব সেকেলে পদ্ধতি। তা ছাড়া কাগজ পত্তরের ব্যবহার আমাদের উঠে গেছে পাঁচ হাজার বছর আগে। আমাদের ভয় দেখানোর হিসেব আপনা-আপনি নিকটবর্তী নীম অথবা শ্যাওড়া গাছের কোটরে জমা পরতে থাকে। নীম, শ্যাওড়ার সঙ্গে আমাদের বহুকাল ধরে লেন দেন হয়ে আসছে কিনা। আমরা ওই গাছ দুটোকে খুব বিশ্বাস করি। এইতো দেখুন, কেলে পেত্নী গত বছর তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে পারলো না। কারণ এক বাড়িতে গিয়ে ভয় দেখানো তো দূরের কথা, সে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেই অজ্ঞান হয়ে পরেছিল। মানুষগুলো অবিশ্যি বুঝতে পারেনি। তাই রক্ষা। আমরা সঙ্গে যারা ছিলাম, তারা গোবর জলের ছিটে দিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরাই। এখন বছর পাঁচেক সে কোনও ভয় দেখানোর কাজই পাবে না। ছেলেটাও তাঁর মুক্ষু হয়ে থাকবে। তবেই বুঝতে পারছেন কেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটা।

যাই হোক, মানুষের ঔদ্ধত্য বেড়ে ওঠার কথা বলছিলাম। আমার ঠাকুরদা ছিলেন ওই আমাদের প্রাথমিক স্কুলের খুব জাঁদরেল মাস্টারমশাই। তিনি যে সব ভয় দেখানোর পদ্ধতি শেখাতেন, তা কোনোদিন বিফলে যেত না। নিচু ক্লাস থেকেই বাচ্চারা খুব ওস্তাদ হয়ে উঠত। বছর পঞ্চাশেক আগেও আমরা একটু খাট, বিছানা নাড়া দিলে মানুষগুলো ভয়ে কাঁপতো। গুঙিয়ে মরা কান্না জুড়লে তো আর কথাই নেই। প্রায় অক্কা। স্কন্ধকাটা হয়ে মানুষের সামনে চলাফেরা করা আজকাল আর হয় না। ওতে মানুষের অক্কা পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভুল করবেন না, ভুতেদের মধ্যেও কতগুলি নীতিবোধ আছে। সেই মানুষগুলো আজকাল বলে কিনা ভুত বলে কিছু নেই। মানুষের বাচ্চাগুলো আমাদের দেখে ভেঙচি কাটে। কি লজ্জা, কি লজ্জা।

বলে রাখি, আমার বয়স আড়াইশোর কাছাকাছি। মরেছিলাম বিষ খেয়ে। খুব কড়া বিষ ছিল। অপঘাতে মৃত্যু কিনা, তাই ভুত হয়েছি। মানুষের ভাষায় আমি হলাম মামদো। কি বিচ্ছিরি নাম বলুন তো। আসলে আমাদের কোনও নাম হয়ে না। আমাদের নির্দেশিকা সংখ্যা হয়। আমার সংখ্যা ৩৫০২০০ । প্রথম দুটো নম্বর হোলো আমি এযাবৎ কয়টি বাড়িকে ভুতুড়ে করে রেখেছিলাম। পরের দুটো সংখ্যা হোলো ভয় দেখানোর কাজ শেষ করতে আমার কত মিনিট লাগে। আর শেষ দুটো সংখ্যা হোলো আমি কয়বার বিফল হয়েছি। বুঝতেই পারছেন, একবারও নয়। এখানে আমাকে সবাই ওই নম্বরেই চেনে। আমি কাজ করি মশানতলার ঘাটে। রাত নটা থেকে রাত তিনটে পর্যন্ত থাকতে হয় ওই ঘাটে। এক রাতে বাড়তি দু ঘণ্টা কাজ করলে দু দিন ছুটি পাই। দু বছর বাদে আমি হেড-অফিসে বদলি হয়ে যাবো। জঙ্গলের শেষ প্রান্তে দেখবেন তিনটে নীমগাছ এক জায়গায় আছে। ওটাই আমাদের হেড-অফিস। তখন নীমের ডালে বসে দিব্যি ঠ্যাং নাড়াতে পারবো।

একটা কথা বলে রাখি। এসব কথা খবরের কাগজের লোকেদের দয়া করে জানাবেন না। আমরা প্রচার একদম পছন্দ করি না।

তাই বলছিলাম, মানুষগুলো আমাদের কি বিচ্ছিরি সব নাম দিয়েছে। আমাদের মধ্যে বিধবা মেয়ে-ভুত যারা, তাদের অবশ্য করে মাছ খেতে হয়। এটাই আমাদের নিয়ম। মানুষগুলো তাদের বলে কিনা মেছো-পেত্নী। হতভাগা, মাছ কি তারা সখ করে খায়? নইলে জানবেন আমরা মাছ, মাংস একদমই খাই না। যে সব মেয়েমানুষ বিয়ে হওয়ার আগেই অক্কা পায়, তারা এখানে এসে বিয়ে করতে চায় না। আমরা কোনও জোর জবরদস্তিও করি না। তারা মানানসই মানুষের খোঁজ পেলে তার ঘার মটকে, এখানে এনে, অমাবস্যার রাতে গায়ে গোবরের পর কচু-দেবতার সামনে তার সঙ্গে ঘেঁটুফুলের মালা বদল করে বিয়ে করে। মানুষেরা তাদের নাম দিয়েছে শাঁকচুন্নি। ঘর-গেরস্থালী করা বধূর এমন কুচ্ছিত নাম দেওয়া উচিত? আর ওই আপনারা কি কি যেন বলেন? ঝ্যাঁটায়-চড়া ডাইনী, উল্টো-পা পেত্নী, আরও কত কি। আমাদের রাজ্যে কেউ ঝ্যাঁটায় চড়ে উড়ে বেড়ায় না। ঝ্যাঁটা ব্যবহার হয় একমাত্র বিয়ের সময়। আর পেত্নীদের পা কখনও উল্টো হয় না। পা উল্টো হলে দুই নারকোল গাছের মাথায় দুই পা রেখে দাঁড়াতে অসুবিধা হতো না?

কচু-দেবতার কথা একটু বলে রাখি। বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আমরাও পূজা করি। পুরাতন মানকচুর গায়ে চামচিকের রক্ত দিয়ে তিলক কেটে তৈরি হয় আমাদের বিগ্রহ। কচি বিছুটি পাতার মালা পরিয়ে আমরা তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করি। আপনাদের তুলসী, আমাদের হোলো বিছুটি। যেদিন গোরস্থানের মাঠে ওই নতুন বিগ্রহ বসানো হয়, সেদিন আমরা সবাই দেহ ধারণ করি। ওই একদিনই আমাদের জামাকাপড় পরতে হয়। একবার একটা মানুষ আমাদের ওই কচু-দেবতার গায়ে পা দিয়েছিল। মরে গেলো পরের দিনই। আত্মহত্যা করলো। আত্মহত্যা করে যারা আমাদের এখানে আসে তাদের কোনও এক কচি মেছো-পেত্নীকে বিবাহ করতে হয়। আমরা অবশ্য আত্মহত্যা করি না। আমাদের হয় আত্ম-জাগরণ। প্রতি পঞ্চাশ বছর পর আমরা কচু-দেবতার সামনে জ্যান্ত চামচিকে বলি দিয়ে আমাদের দীর্ঘ আয়ু কামনা করি।

অমাবস্যার বিভীষিকা আমাদের এই সমাজের সবচেয়ে বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ভুত। বয়স দু হাজার পেরিয়ে গেছে। এখন সে অবসরপ্রাপ্ত। সে নাকি একবার নেপোলিয়নের তাবুতে ঢুকে তার লুঙ্গির খুঁট ধরে টেনেছিল। পরদিন নেপোলিয়ন ভয়ে যুদ্ধে যান নি। হাঁ, ভয় দেখাতেও সাহস লাগে। নেপোলিয়নের তাবুতে ঢোকা কি যে সে কথা? সে বলছে ভুতেদের খুব দুর্দিন আসছে। কারণ মানুষেরা নাকি অন্য গ্রহে বসবাসের ব্যবস্থা প্রায় পাকা করতে চলেছে। মানুষ না থাকলে কি আর ভুতেদের দিন চলবে?

1 comment:

  1. নিজের পুরাতন লেখাটি পড়ে ভালোই লাগলো।

    ReplyDelete

অনুগ্রহ করে আপনার ব্ক্তব্য এইখানে অবশ্যই লিখুন......

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...