
জয়তির কথা প্রনবেশ আজ যেন কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। একটা অপরাধী ভাব তার মনকে বারবার নাড়া দিচ্ছে। দীর্ঘ চোদ্দ বছর বাদে জয়তির সঙ্গে তার এইভাবে দেখা হবে প্রনবেশ কোনদিন ভাবেনি। সে ও জয়তি কলেজে একই সঙ্গে পড়তো। ঊনিশশো পঁচাশি সালের কথা। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর হৃদয়ের দেওয়া নেওয়া। উভয়ের প্রতি গভীর বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল খুব তাড়াতাড়িই। কলেজের পর কত বিকেল কেটেছে দুজনের একসাথে পথ চলতে চলতে। এক এক দিন দেরী হয়ে গেলে প্রনবেশ জয়তিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর বাড়ি ফিরত।
কলেজ পাশ করবার পরে প্রনবেশ এক সরকারি দপ্তরে চাকরিও পেয়ে যায়। জয়তি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোনও এক কোর্সে ভর্তি হয়।
এইভাবে বছর দুয়েক কেটে যায়। জয়তি এম এ পাশও করে যায়। কিন্তু তাদের বিয়েতে বাধ সাধলো প্রনবেশের মা। জয়তির বাবা ছিলেন না। জয়তি যখন পাঁচ বছরের, তখন সে তার বাবাকে হারায়। তার মা এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে জয়তিকে মানুষ করেন। আর্থিক সঙ্গতি তাঁর বিশেষ ছিল না।
প্রনবেশ তাঁর মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেনি। ভেবেছিল ধীরে ধীরে মা হয়ত নরম হয়ে মত দেবেন। তাই সে জয়তিকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। উত্তরে সারাজীবন অপেক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জয়তি।
কোনও এক সন্ধ্যাবেলায় দুজনে গঙ্গার পাড়ে বসেছিল। প্রনবেশ কথায় কথায় বলে, "আমার সবচেয়ে অমূল্য যা কিছু আছে তা চিরকাল তোমার জন্যই থাকবে জয়ী। থাকবে সে সবের ওপর তোমার সারা জীবনের অধিকার।" প্রনবেশের হাত দুটো ধরে জয়তি প্রশ্ন করেছিল, "মনে রাখবে তো?" প্রনবেশ উত্তর দিয়েছিল, "রাখবো।"
মার অবসরপ্রাপ্তির পর জয়তি ও তার মাকে কলকাতার বাড়ি ছেড়ে বর্ধমানে চলে যেতে হয়। জয়তি সেখানে এক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে কাজ পেয়ে যায়। এইখান থেকেই জয়তি ও প্রনবেশের যোগাযোগ একটু একটু করে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সারা সপ্তাহ অফিস করে প্রনবেশ সপ্তাহের শেষে প্রায়ই আর দেখা করতে যেতে পারতো না। টেলিফোনে দু জনের কিছু কথা হতো, তবে তা খুবই সামান্য। জয়তির বাড়িতে তখন টেলিফোন ছিল না। দু একবার জয়তি স্কুল ছুটি নিয়ে প্রনবেশের সঙ্গে অফিসে দেখা করতে এসেছিল। তবে জয়তির মা অসুস্থ হয়ে পরার পরে সেটাও আর সম্ভব হতো না।
বছর খানেকের মধ্যে প্রনবেশের মা প্রনবেশের বিয়ে ঠিক করলেন তাঁর নিজেরই এক বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে। প্রনবেশ অনেক চেষ্টা করেছিল বিয়েটা আটকাবার। শেষমেশ মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রনবেশকে মত দিতেই হোলো। হয়ে গেলো বিয়ে। জয়তি জানতে পারলো বিয়ের মাস খানেক পরে। আর সে গত চোদ্দ বছরে প্রনবেশের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও চেষ্টা করেনি।
তারপর আজ রাতে এক বিয়েবাড়িতে দুজনের অকস্মাৎ দেখা। জয়তি নিজেই এসে কথা বলে। তার চোখে মুখে আজ এক খুশীর জোয়ার দেখেছিল প্রনবেশ। সে বিয়ে করেনি। আর সেটাই প্রনবেশকে আজ রাতে এক অপরাধ বোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কই, জয়তি তো কোনও অনুযোগ করলো না। তারা দুজন তো অনেকক্ষণ একা কথা বলেছিল। সুপর্ণাও কাছাকাছি ছিল না। যাওয়ার আগে প্রনবেশের অফিসের ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর সে নিজেই চেয়ে নিয়ে যায়। বলে যায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে যোগাযোগ করবে।
এর পর কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। জয়তির সঙ্গে প্রনবেশের এর মধ্যে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। তার মা মারা গেছেন। সে এখন বর্ধমানে একাই থাকে। জয়তি অতীতের কোনও কথা একবারের জন্যও বলেনি। প্রনবেশ এতে আরও অবাক হতে থাকে। কেমন একটা অজানা আশঙ্কা তার মনে দানা বাঁধতে থাকে। আজকাল সে বাড়িতেও বিশেষ কথা বলে না। তা সুপর্ণার লক্ষ্য এড়ায় নি। প্রনবেশ অফিসের নানান ঝামেলার কথা বলে এড়িয়ে যেতে থাকে। ছেলে শান্তনুর সঙ্গে রাতে অফিস থেকে ফিরে প্রনবেশ অনেকটা সময় কাটাতো। আজকাল তাও প্রায় বন্ধ।
দিনটা ছিল রবিবার। জয়তির অনুরোধে তারা দুজন সেদিন বিকেলে গিয়েছিল সেই গঙ্গার পাড়ে। জয়তি ছিল সেদিন খুবই চুপচাপ। সন্ধ্যা নেমে আসছে গঙ্গার বুকে। ওপারে কল-কারখানার কিছু আলো জ্বলে উঠতে দেখা গেলো। আলো পড়ে গঙ্গার জলটা চিক্ চিক্ করছিল। জয়তির চোখ দুটোও তেমনই চি্ক চিক্ করে উঠলো। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে জয়তি বললো, "আজ যদি আমার অধিকারের থেকে এক কণামাত্র চাই, আমায় দেবে প্রনবেশ?" প্রনবেশের মনে একটা ধাক্কা লাগলো। কি চাইবে জয়তি। প্রনবেশ বলে, "আমি চেষ্টা করবো জয়ী, তুমি বলো।"
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে জয়তি বললো, "বাকি জীবনের বাঁচার কোনো অবলম্বন আমায় দেবে?"
"কি চাও বলো, জয়ী", প্রনবেশ উত্তর দেয়।
"আমাকে একটা সন্তান দেবে প্রনবেশ?" জয়ী খুব ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে। তার কণ্ঠে কোন জড়তা ছিল না।
"সুপর্ণার তো সব আছে। আমার কি আছে বলো?" জয়তি বলে চলে।
প্রনবেশের মাথাটা মুহূর্তের জন্য ঘুরে যায়। যে অধিকার জয়তিকে সে একদিন বিনা সর্তেই দিয়েছিল, তার কথা প্রনবেশের মনে পড়ে যায়। এমনভাবে কোনও মেয়ে তার অধিকার চাইতে পারে? কে যেন তার ভিতর থেকে বলে উঠলো, "পারে, প্রনবেশ পারে। সত্যিকারের ভালবাসলেই পারে। ভালবাসার অধিকার যে সবার ওপরে।"
তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে প্রনবেশ বলে, "তুমি সত্যি চাও, জয়ী? তাহলে দেবো।"
এর পর সেদিন আর বিশেষ কথা হয়ে নি দুজনের।
দু বছর পরের কথা। জয়তি বর্ধমানে আর থাকে না। স্কুলের কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে প্রনবেশের ছয় মাস বয়সের পুত্র সন্তান। প্রনবেশের তাকে খুঁজে পাওয়ার আর কোন উপায় রইল না। জয়তি জানতো প্রনবেশ নিজের সন্তানকে ভুলতে পারবে না। সুপর্ণার জীবন সে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দিতে চায়ে নি। তাই সে ছেলেকে নিয়ে প্রনবেশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলো। প্রনবেশ যাতে আর কোনদিন তার ও তার ছেলের খোঁজ না পায়।
- ফেব্রুয়ারী, ২০০৪ Tweet