"পাঠক,পাঠিকাদের মতামত বা মন্তব্যই তো লেখকদের লেখিকাদের পুনরায় লিখিবার একমাত্র প্রেরণা। তাই দয়া করিয়া মতামত দিতে ভুলিবেন না, তা সে যেমনই হউক না কেন ।" http://tobey-shono.blogspot.com

Tuesday, April 9, 2013

বিদায়ী বসন্তের প্রেম

জীবনকিশোর আজকাল তার নিজের কাজ লইয়াই ব্যস্ত থাকে। যৌবনানন্দের দিকে নজর দেওয়ার বিশেষ সুবিধা আর নাই। যৌবনানন্দের বয়সও অনেক হইয়াছে। অনেক কাল হইলো সে একই ভাবে জীবন কাটাইতেছে। বসন্তের দেখা বহুকাল সে পায় নাই। আর ভালো লাগিতেছে না। এবার দিগম্বর হইয়া বাণপ্রস্থে যাইবার সময় বুঝি হইয়াছে। একদিন সে জীবনকিশোরকে ইহা কহিয়াই ফেলিল।  
যৌবনানন্দের এমন ভাবগতিক দেখিয়া জীবনকিশোরের হৃদয় উত্তাল, উদ্বেল হইয়া উঠিল। কহিল, 'যাস নে বাপ! তুই গেলে আমার আর কি থাকিবে রে? আর কয়টা বৎসর সবুর করিয়া যা। তোকে আমি রোজ চিতল মাছের পেটি, কচি লাউএর ঘণ্ট,  বিলিতি আমড়ার অম্বল, নেয়াপাতি ডাবের শাঁস ও তার জল খাওয়াইব।"

কিন্তু যৌবনানন্দ কোনও কথাই শুনিতে চাহে না। সে কহিল, 'কাঁচা-লঙ্কা, কালোজিরা দিয়া জ্যান্ত খুকি ইলিশের ঝোল খাওয়াইতে পারো রোজ? খোকা হইলে চলিবে না।" ইহা জীবনকিশোরের পক্ষে সম্ভব নহে। ইলিশ চাই জ্যান্ত, তার মধ্য হইতে আবার খুকি। খানিক ভাবিয়া সে উত্তর করিল, তুই কুমড়ার ছক্কা খাইবি? বড় উৎকৃষ্ট খাইতে। অথবা কাঁচকলার ডালনা? কচি-বেলায় তোকে অনেক খাওয়াইয়াছিলাম না?" যৌবনানন্দ কোনও কথা কহিল না। গুম হইয়া বসিয়া রহিল।

"তুই তো এমন অবাধ্য ছিলি না। তোর এমন মতি হইলো কেন?", কহিল জীবনকিশোর।

যৌবনানন্দ খানিক নালিশ জানাইবার সুরে কহিল, "কেন, সেদিন পুকুর ঘাটে দুই দণ্ড দাঁড়াইতে কি হইয়াছিল? কেদার চাটুজ্জের কচি ডাগর-ডুগুর বউটি কেমন ডুম্বুর গাছের ডালে বসিয়া পা দিয়া জলে ছলাৎ, ছলাৎ শব্দ করিতেছিল শাড়ি কাপড়ের দিকে কোনও ভ্রূক্ষেপই ছিল না। একটি পা নামিতেছে, তো অন্য পা উঠিতেছে, সেটি নামিতেছে তো অন্যটি উঠিতেছে। নিশ্চয় নাইতে আসিয়াছিল। আচ্ছা, আমাকে কি এতটুকুও বিশ্বাস করিতে পারো না? তেমন কিছু অঘটন বাধাইতাম না, ইহা নিশ্চিত বলিতে পারি।"

উত্তরে জীবনকিশোর কহিল, "বাপ, এক্ষণে কি আর আমার সেই বয়স আছে? লোকে দেখিলে কি কহিবে? আর রসকে তো দিন, দিন যেদিক, সেদিক দিয়া বাড়িয়া  চলিতে দেওয়া যায় না। বুঝিয়া কাজ করিতে হয়। দিনকাল ভালো নয়।" 

"তবে তুমি তোমার বয়সের ভার, ধুতির কোঁচা আর বুড়া দন্ত সামলাও। আমি চলিলাম। এমন নুইয়া পরা মানুষের সহিত আমার বনিবে না", কহিল যৌবনানন্দ।

"কেন রে, তোকে সেদিন বৈকালে হাটের পথে নেত্যকালির সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিলাম না? কি সুন্দর কথা কয় নেত্যকালি। চোখে মুখ হইতে যেন রূপ-লাবণ্য ঝরিয়া, ঝরিয়া পরিতেছিল। ঠিক যেন পাকা নেংরা আমটি।" জোর গলায় কহিল জীবনকিশোর।

"তোমার ভীমরতি হইয়াছে, জীবনকিশোর, তোমার ভীমরতি হইয়াছে। ওই নেত্যকালিকে দেখিবামাত্রই তো মনে হইলো কোনও কয়লার খনিতে উহার জন্ম। আর অঙ্গের এখান ওখান হইতে যেন ন্যাকড়ার পুঁটুলি ঝুলিতেছে। চেহারার কোনও ছিরিছাঁদ আছে? তায় আবার কহিল পাঁচ সন্তানের জননী। তোমার অধীনে থাকিলে গলায় তেঁতুল বীচি আটকাইয়া আমি মরিব, ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই। এক্ষণে দিন পালটাইয়া  গিয়াছে। কচি, কচি কাঁঠালচাঁপার দল খোলামেলা শরীর-মন লইয়া নলেন গুড়ের পিঠা-পায়াস সাজিয়া যত্রতত্র ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আমার মন আর শান্ত থাকিতেছে না। আমি  পিঠা-পায়াস, পরমান্ন খাইতে চাহি। তোমাকে অবলম্বন করিয়া আর দিন চলে না।", কহে যৌবনানন্দ।

জীবনকিশোর মনে বল সঞ্চয় করিয়া কহিল, "বুঝিলাম, তোর কথা। তবে কিনা এক্ষণে নলেন গুঁড়ে আর আগের মত মিষ্টও নাই, সুবাসও নাই। আর ওই সব পিঠা-পায়াস যা দেখিতেছিস, তা সকলই লবণাক্ত। তোকে বরং আম, কলা আনিয়া খাওয়াইব, অথবা কচি বেলের মোরব্বা। তুই কেমন কলা খাইতে ভালবাসিতি।"
"তোমার ওসব কথায় আর ভুলিতেছি না। কিছুদিন আগে একবার জালের পোশাক পরা টিকিট লাগানো রাঙা, রসালো আপেল খাইতে চাহিয়াছিলাম তোমার কাছে। তুমি কহিয়াছিলে উহা টক। বেবাক মিথ্যা কথা। ঘ্রাণেই বুঝিয়াছিলাম উহা অতীব মিষ্ট। পরে জানিয়াছি উহা বিদিশীও বটে। আমার পাওনা গণ্ডা মিটাইয়া দাও। আমি বিদায় লই।", কহে যৌবনানন্দ। 
"ঠিক আছে। তুই যখন যাইবিই স্থির করিয়াছিস তখন তোকে আর ঠেকাইব না। তা তোর পাওনা গণ্ডা কিসের শুনি?" প্রশ্ন করে জীবনকিশোর।
যৌবনানন্দ চুপ করিয়া থাকে।
কহিয়া চলে জীবনকিশোর, "আমি যদি হই নদী, তুই আমার স্রোত। নদী না থাকিলে তো স্রোতের কোনও অস্তিত্বই নাই। জানিবি, আমাকে ছাড়িয়া তুই বাঁচিবি না। সাগরে নিঃশেষ হইবার আগে পর্যন্ত নদীকে অবলম্বন করিয়াই স্রোতকে চলিতে হয়। আমার মধ্যা দিয়াই তোর মুক্তি।"
খানিক ভাবিয়া যৌবনানন্দ অবশেষে কহিল, "তবে চলো, বিলাপ ছাড়িয়া দুইজনে মিলিয়া অস্তগামী দিবাকরের আলোয় ভর করিয়া পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার শোভা দেখিতে, দেখিতে ভালোলাগা ও ভালবাসার ঊর্ধ্বে উঠিয়া যৌবনকে নূতন করিয়া প্রেমের আলোকে দর্শন করি।"

No comments:

Post a Comment

অনুগ্রহ করে আপনার ব্ক্তব্য এইখানে অবশ্যই লিখুন......

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...