"পাঠক,পাঠিকাদের মতামত বা মন্তব্যই তো লেখকদের লেখিকাদের পুনরায় লিখিবার একমাত্র প্রেরণা। তাই দয়া করিয়া মতামত দিতে ভুলিবেন না, তা সে যেমনই হউক না কেন ।" http://tobey-shono.blogspot.com

Friday, June 14, 2013

কি জ্বালা

সংসারের ভেলায় ভাসমান গোবর্ধন বাবুর অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। সংসারের ভার সামলাইতে তো কাহিল অবস্থা বহুদিন যাবৎ। বাবা নীলমণি, অর্থাৎ তাহার পুত্র একটু, একটু করিয়া একটি উড়ন্ত ফুলবাবু হইয়া উঠিয়াছে। ফুলের রেণু খুঁজিতেছে কিনা বলা যাইতেছে না। আর তাহার কন্যারত্নটি এক্ষণে মাঝে মধ্যে মধুবনে বেড়াইতে চাহে। তাহার স্ত্রী অবলা দেবী সংসার ব্যতীত আর চতুর্দিকেরই খোঁজ রাখেন। বুঝা যাইতেছে অবলা দেবীর প্রশ্রয়তেই পুত্র ও কন্যা দুইজনই গোল্লায় যাইতে বসিয়াছে। গোবর্ধন বাবুর মতে তাহাকে গলায় দড়ি আঁটিয়া মাঠে খোঁটার সহিত বাঁধিয়া দিয়া আসিতে হয়। ব্যাপারটি কতকটা এইরকম - খা, কত ঘাস খাবি খা। ছাগলের আর অন্য কি কাজ? কোথা হইতে এমন উপাদেয় একটি সংসারের ব্যবস্থা করিয়া নিজের ক্রমবর্ধমান শিরঃপীড়াটি ডাকিয়া আনিলেন গোবর্ধন বাবু তাহা তিনি নিজেও বুঝিতে পারেন না। বলিতে হয় ওনাকে কুকুরে নয়, বোধকরি ছাগলে কামড়াইয়াছিল।

গোবর্ধন বাবুর বক্তব্য, পুত্র, কন্যা ও তাহাদের মাতা তাহাকে খোলা বাজারে বেচিয়া দিবার মতলব করিতেছে। ইহা তিনি পাড়ার নগেন মুদির কাছে ব্যক্ত করিয়াছেন। কথাটি বিশ্লেষণ করিলে যাহা দাঁড়ায় তাহা হইলো তিনজনে মিলিয়া গোবর্ধন বাবুকে অবলম্বনহীন করিবার বিপুল প্রচেষ্টা চালাইতেছে। এই বিষয়ে তিনি আরও বলিয়াছেন যে যাহা কোনোদিন কিনিতেই পারিল না তাহার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা, তাহা তাহারা বেচিবে কোন এক্তিয়ারে? তবে এ ভুল তারা করিবে না ইহা হলপ করিয়া কওয়া যায়। তিনি এক্ষণে তার পরিবারকে একপ্রকার এড়াইয়াই চলেন। এই বিষয়ে তার বক্তব্য ছুঁচাকে লাঠি দিয়া মারিলেও গন্ধটা হাতেই হইয়া থাকে। তা তিনি চাহেন না। নিজের উপার্জনের কর্মটুকু রক্ষা করিয়া বাকি সময় নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ হইয়া থাকাই তিনি সমীচীন মনে করেন। এবং তাহার পরিবারকে আচরণের দ্বারা বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছেন সে তাহারা যেন গোবর্ধন বাবুর সহিত বেশী ঘন হইবার প্রচেষ্টা হইতে বিরত থাকে।

এমন কত গোবর্ধন বাবু আছে জগতে তাহা কে আর কহিতে পারে।

কামড়া - কামড়ি

কামড়া-কামড়ি

রামবাবুর স্ত্রী ইশকুলে শিক্ষকতার কাজ করেন।
ইশকুলে যে নতুন প্রধান শিক্ষিকা নিয়োগ হইবে, সে প্রধান হিসাবে কেমন মানুষ হইবে, এই বিষয়ে রামবাবুর স্ত্রী মন্তব্য করিয়াছেন, "আমাদের কামড়াইলে আমরাও কামড়াই।"
শুনিয়া রামবাবু বলিয়াই ফেলিলেন, "সর্বনাশ!!!!!! সে তো শিয়াল-কুকুরের স্বভাব।" তিনি বলিয়া চলিলেন, "না না, কামড়, টামড় দেওয়া উচিত নয়। মানুষের কি উহা সাজে? বড় জোর আঁচড়াইয়া দিতে পারো। তাও ঠিক ভালো দেখায় না।"

শুনিয়া রামবাবুর স্ত্রী একটু ক্ষুণ্ণ বোধ করিলেন। মুখে কিছু বলিলেন না।

Friday, June 7, 2013

নোলক

কোথা হইতে কি যে হইলো অভয় বুঝিতে পারিল না। হতবুদ্ধি হইয়া খানিকক্ষণ কদম গাছের তলায় দাঁড়াইয়া রহিল। এমন কি বলিল সে যে ফুলটুসি একেবারে গোত্তা মারিয়া উল্টা দিকে হাঁটিতে শুরু করিল। হঠাৎ কি মনে হইতেই সে চেঁচাইয়া বলিয়া উঠিল, "অরে অ ফুলটুসি, যাস নে, শোন। নাকের নোলক কিনে দেব অখন।" শুনিয়া ফুলটুসি ফিরিয়া তাকাইল। অভয় স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলিল।

বলিয়া রাখি অভয় এবং ফুলটুসি দুইজনেই ময়নাতলা গ্রামে থাকে। বয়সে দুইজনেই কচি, এই আঠারো-কুড়ি হইবে। সদ্য একে অপরকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে। প্রেম আবার যা তা প্রেম নয়। অভয় ফুলটুসির খোপায় চাঁপাফুল গুজিয়া দেয়, ফুলটুসি কদম গাছের তলায় বসিয়া অভয়ের চুলে বিলি কাটিয়া দেয়, অভয় ফুলটুসির জন্য ছোলা-ভাজা আনে তো ফুলটুসি অভয়ের জন্য গৃহ হইতে লুকাইয়া মুড়কি লইয়া আসে। তারা ঠিক করিয়াছে বিবাহ তাহারা করিবেই। যদি দুই জনের মা বাবা রাজি না হয় তো পালাইয়া গিয়া তাহারা বিবাহ করিবে।

এ হেন ফুলটুসি বায়না ধরিয়াছে তাহাকে নাকের নোলক কিনিয়া দিতে হইবে। অভয়ের পয়সা নাই। তাই সে একটু কিন্তু, কিন্তু করিতেই ফুলটুসির যত রাগ।

অভয়র বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। অভয় তার একখানি জামা বেচিয়া দিয়া সেই পয়সায় গ্রামের মেলা হইতে একখানি নোলক অবশেষে কিনিল। নোলক পাইয়া ফুলটুসির সে কি আনন্দ। খানিক নাচিল, খানিক হাসিল তাহার পর অভয়কে জড়াইয়া ধরিয়া খানিক কাঁদিয়াও লইল। তাহার পর সে নোলকটি পরিয়াই ফেলিল। কিন্তু নোলকটি পড়িয়া গৃহে যাইতে পারিল না। মা জানিলে একখানা হাড়ও আস্ত থাকিবে না। গৃহে যাওয়ার পূর্বে নোলকটি খুলিয়া অভয়কে দিয়া গেলো। কহিল বিবাহের দিন অভয় যেন তাহাকে নোলকটি পরাইয়া দেয়।

এমনি করিয়া মাস দুই আরও চলিল। তাহাদের প্রেম আরও নিবিড় হইলো।

একদিন হঠাৎই ফুলটুসি আসিল না বৈকালবেলা কদমতলায়। অভয় মনখারাপ করিয়া গৃহে ফিরিল। পরদিন সকালে ফুলটুসির ভাইয়ের নিকট হইতে জানিতে পারিল ফুলটুসিকে লইয়া তাহার মা ফুলটুসির মামাবাড়িতে গমন করিয়াছে।

প্রথমটা অভয় ভাবিল দুই চারি দিনের মধ্যেই ফুলটুসি ফিরিয়া আসিবে। কিন্তু ফুলটুসি ও তাহার মা ফিরিল না। ইহার পর হইতে অভয় বৈকালে একাই গিয়া কদম গাছের নীচে বসিয়া থাকে। অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিয়া সন্ধ্যা হইলে মুখ কালো করিয়া একসময় গৃহে ফেরে। নোলকটি সর্বদা তার জামার পকেটেই থাকে।

ইহার মাস-খানেক বাদে অভয় একদিন দেখিল ফুলটুসিদের বাড়িতে খুব খানিকটা জাঁকজমক। পাড়া-পড়শির নিকট হইতে জানিল ফুলটুসির বিবাহ। শুনিয়া অভয় ছুটিয়া কদম গাছের তলার গিয়া বসিয়া পরিল। গৃহে ফিরিল সে অনেক রাতে।

ফুলটুসি চলিয়া গেলো বঁধু সাজিয়া কোনও এক অচিন গ্রামে। অভয়ের কাছে পড়িয়া রহিল তার নোলকটি।

ইহার পর অনেক বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। অভয় বিবাহ করিয়া সংসারী হইয়াছে। অভয়ের বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়। সেই কদম গাছটিও বৃদ্ধ হইয়াছ। নিজ গ্রামেই বসবাস করিতেছে অভয় স্ত্রী পুত্র কন্যা লইয়া। নোলকটি তার কাছে এখনও রহিয়াছে। আর তো কেহ তাহার কাছে অমন করিয়া নোলক পড়িতে চাহে নাই। মাঝে, মাঝে কদমতলায় গিয়া পকেট হইতে নোলকটি বাহির করিয়া দেখে। বিবর্ণ, তামাতে হইয়া গিয়াছে সেইটি।

Wednesday, June 5, 2013

ইহারেই কহে খিচুড়ি

কেহ, কেহ কম বুদ্ধিবসতঃ জীবনে প্রচুর রেলগাড়ি "মিস্" করে। দৌড়াইয়া, লাফাইয়া ইস্টিশনে পৌছায় বটে, তবে রেলগাড়িতে চাপিতে পারে না। গাড়ি আগেই ছাড়িয়া চলিয়া যায়। ইহারা তাহারা নহে, যাহারা হাতে টিকিট লইয়া ঘরে বসিয়া থাকে, ইস্টিশনে যায়ই না। তাহারা অন্য জাতীয়।

সমপরিমাণ বুদ্ধি একটি হনুমানের মাথায় বেশী কাজ দেয় মানুষের মাথার তুলনায়। মানুষের মাথায় একই বুদ্ধি কম কাজ দেয় কারণ তাহা হ্রাস পাইয়া যায় মানুষের জেদের বশে, মানুষের অহংকারের কারণে।

যদি সত্যই কাহাকেও ভালবাসিতে চাও, তবে তাহার দোষ, গুণ বিচারের ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে।

কাহাকেও সম্মান দেখাইতে কোনও অসুবিধা হয় না, যদি সেও আমাকে যথেষ্টই সম্মান প্রদান করে।

একবিংশ শতাব্দীর শুরু হইতেই নারদ স্বর্গে বসিয়া শুধু বগল বাজাইতেছেন, এবং চতুর্দিকে অবিরাম উদ্দাম নৃত্য চলিতেছে। দেবতাগণ বোধকরি নিদ্রা গিয়াছেন।

মানুষ ভূ ছাড়িয়া ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে বহুকাল আগেই, ইহার পর বাতাসে হাঁটিবে। ভূএর প্রয়োজন একেবারে মিটিয়া যাইবে নাকি?

একটা দিন সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ না হইলে দিনশেষে সুখনিদ্রাও ভোগ করা যায় না। এমনটাই তো প্রতিটি দিন। কথা বলার মনের মানুষটিকে  তাই তো চাই।

আজ হইতে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে মুদি দোকানে কোনও জিনিস খরিদ করিতে গেলে আমিই থাকিতাম একমাত্র খরিদ্দার ওই সময়টুকুতে, অথবা এক, দুইজন ক্রেতা আমার পূর্বে থাকিত। এবং তাহাদের ফর্দও থাকিত খুব সংক্ষিপ্ত। আজ ক্রেতার সংখ্যাও বাড়িয়াছে, সেই সঙ্গে ফর্দের দৈর্ঘ্যও। ফল স্বরূপ মনে বিরক্তির উদ্রেক হয় প্রায়শই।

ঝরা পাতা আমারে ডাকিয়া কয়, "তোমাদের ভাবনাগুলির মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইডের বিষ ঢুকিয়া গিয়াছে। মূল্যবোধগুলি সব কোয়াসিমোডোর বিকৃত চেহারা ধারণ করিয়াছে। কোয়াসিমোডোর বিকৃত চেহারার রূপটি না আঁকড়াইয়া তাহার মনের হদিস পাইবার চেষ্টা করো। প্যারিসের ন্যোটর ড্যাম ক্যাথেড্রালের আশেপাশের অলিতে, গলিতে আজও তার মহানুভবতার বাতাস খেলিয়া বেড়ায়। সেই বাতাসে শ্বাস লইয়া আইসো। খুঁজিলে হয়ত এস্মেরালডার সরলতা ও রূপ-লাবণ্যের মহিমার অনুভবও পাইতে পারো।"

ধুলা ও বালি

শিশুকালে ধুলা বালির মধ্যে খেলিয়া বড় হওয়া, এবং শেষকালে এই নশ্বর দেহের আবার ধুলা বালিতেই বিলীন হওয়া - মধ্যখানটা কি ধুলা বালি বিহীন হইবে? ধুলা আমাদের জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ধুলা বালি হইতে কে কবে বাঁচিয়াছে?

------------------------------------------------------------

কোনও কিছুকে বাণিজ্যিক জায়গায় লইয়া গেলেই তাহা আবশ্যক হইয়া পরে। সকল কিছু দরদাম করিবার পণ্য নহে। বিপণনের জায়গায় নিলেই তাহা প্রয়োজনের বাধ্য হইয়া পরে। তখনই তার মাধুর্য-চ্যুতি হয় ও জৌলুস হারায়। চারিদিক হইতে কয়েদখানার গারদ আসিয়া ঘিরিয়া ধরে। বিপণনের ক্ষেত্র যতই বাড়িতে থাকিবে, শিল্পের ক্ষেত্র ততই তার মাধুর্য হারাইবে। তবে কিছু করার নাই। অর্থনীতির নিয়মে ইহা হইবেই। "মৎস্য মারিব, খাইব সুখে", সেই দিন চলিয়া গিয়াছে।

Thursday, May 30, 2013

সৃষ্টির লীলা ও অগ্রগতির মূল

প্রতিটি নূতন আবিষ্কার আমাদের সামনে নূতন বিস্তীর্ণ দিগন্ত খুলিয়া দিতেছে প্রতিনিয়ত। সেই দিগন্তের দিকে ভালো করিয়া না চাহিয়া আমরা সামান্য জ্ঞান লইয়া সুখনিদ্রার আয়োজন করিতেছি। ভাবিতেছি, যা জানিয়াছি এই তো অনেক। ইহার অধিক জানিবার, দেখিবার আর কি আছে? অচিরেই আমি আমার ঘটি, বাটি, ছাতা, লাঠি ও চার দেওয়ালের বন্ধন লইয়া হাঁপাইয়া উঠিলাম। পুরাতন সকল কিছুর মধ্যে মন নিরানন্দ হইয়া পরিল।

হঠাৎ  কানে আসিয়া কে যেন কয়টি মন্ত্র কহিয়া গেলো, আর আমার নিদ্রা পলায়ন করিল তৎক্ষণাৎ। এই সেই জ্ঞান সমুদ্রের আনন্দ তরঙ্গ। এইখানে আনন্দ সুখকে বর্জন করিয়া, নিদ্রাকে জয় করিয়া জ্ঞান সমুদ্রে সন্তরণের জন্য সদা আহ্বান করিতে থাকে আমাদিগকে। নূতনের গন্ধ পাইলেই মনুষ্য হৃদয় চঞ্চল হইয়া উঠে। আর সে শুইয়া থাকিতে পারে না, নিদ্রা যাইতে পারে না। বাহির হইয়া পরে পথে। অজানাকে জানিবার আকর্ষণ তাহাকে সদাই ব্যস্ত রাখিয়াছে, এবং রাখিবেও। তখন দুঃখও আর দুঃখ দিতে পারে না, সে তখন কেবল জাগায় আমদের মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্বের বহু ধর্মের মধ্যে একটি হইলো তার জ্ঞানের আহরণের পিপাসা। দুঃখ কেবলই বলিতে থাকে, তুমি মানুষ, সুখ তোমার জন্য নয়। উত্থিত হও, জাগ্রত হও। সামনে যে বিস্তীর্ণ ভূমি পাইলে তাহা ভালো করিয়া নাড়িয়া, চাড়িয়া দেখো। আরও নূতন, নূতন দিগন্তের সন্ধান করো। নিজেকে ব্যাপ্ত করো। গ্রহ হইতে গ্রহান্তরে যাইবার আয়োজন করো।

তবেই তো কোটি, কোটি বৎসর ব্যাপী এই সৃষ্টির লীলা অর্থবাহী হইয়া উঠে। তুমিই সেই মানবসন্তান যার নিমিত্ত এই পৃথিবীর সৃষ্টি, হয়ত বা এই ব্রহ্মাণ্ডেরই সৃষ্টি।

ময়ূরের গায়ের পালকে ঈশ্বর নানান রঙ লাগাইয়া দিয়াছেন নিজেই। এমন আরও অনেক পশুপক্ষী আছে। কিন্তু মানুষের গায়ে তেমন বিচিত্র রঙ না দিয়া তিনি মানুষকে দিয়াছেন রঙ ও তুলি। মানুষ তার ইচ্ছামত যাহাতে রঙ লাগাইতে পারে। ঈশ্বর দেখিতে চান মানুষ তার মগজ খাটাইয়া কেমন রঙ লাগাইতে পারে। ইহাই প্রকৃতরূপে ঈশ্বরের খেলা। তিনি সদা, সর্বদা এই খেলা দেখিতেছেন ও সর্বানুভূ এবং আনন্দময় হইয়া আছেন। সেই সদা আনন্দময় পরমাত্মার সহিত যোগাযোগ রাখিয়া আমাদের আত্মাকে আনন্দময় রাখিবার উপায়ই হইলো সুখ ও দুঃখের সাগর পার হইয়া জ্ঞান সমুদ্রে সন্তরণ দেওয়া। জানিও জ্ঞান সমুদ্রের প্রতিটি তরঙ্গে শুধুই আনন্দ বিরাজ করিতেছে।

মানব সভ্যতার অগ্রগতি এইভাবেই ঘটিয়াছে, এবং ঘটিতে থাকিবে। তবে না যেন আমরা কভু ঈশ্বরকে তথা প্রকৃতিকে অতিক্রম বা লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করি। অখণ্ডতাকে আশ্রয় করিয়া কি করিয়া একত্রে আগাইয়া যাইতে হয় তার সকল নির্দেশ ওই জ্ঞান সমুদ্রেরই অতলে রহিয়াছে। ইহা একবার আহরণ করিয়া আনিতে পারিলেই মানুষের সকল কর্ম সদা মঙ্গলময় হইবে। ইহা এক অতি কঠিন কর্ম। তবু মানুষকে ইহা একদিন সম্পন্ন করিতেই হইবে।

Tuesday, April 9, 2013

বিদায়ী বসন্তের প্রেম

জীবনকিশোর আজকাল তার নিজের কাজ লইয়াই ব্যস্ত থাকে। যৌবনানন্দের দিকে নজর দেওয়ার বিশেষ সুবিধা আর নাই। যৌবনানন্দের বয়সও অনেক হইয়াছে। অনেক কাল হইলো সে একই ভাবে জীবন কাটাইতেছে। বসন্তের দেখা বহুকাল সে পায় নাই। আর ভালো লাগিতেছে না। এবার দিগম্বর হইয়া বাণপ্রস্থে যাইবার সময় বুঝি হইয়াছে। একদিন সে জীবনকিশোরকে ইহা কহিয়াই ফেলিল।  
যৌবনানন্দের এমন ভাবগতিক দেখিয়া জীবনকিশোরের হৃদয় উত্তাল, উদ্বেল হইয়া উঠিল। কহিল, 'যাস নে বাপ! তুই গেলে আমার আর কি থাকিবে রে? আর কয়টা বৎসর সবুর করিয়া যা। তোকে আমি রোজ চিতল মাছের পেটি, কচি লাউএর ঘণ্ট,  বিলিতি আমড়ার অম্বল, নেয়াপাতি ডাবের শাঁস ও তার জল খাওয়াইব।"

কিন্তু যৌবনানন্দ কোনও কথাই শুনিতে চাহে না। সে কহিল, 'কাঁচা-লঙ্কা, কালোজিরা দিয়া জ্যান্ত খুকি ইলিশের ঝোল খাওয়াইতে পারো রোজ? খোকা হইলে চলিবে না।" ইহা জীবনকিশোরের পক্ষে সম্ভব নহে। ইলিশ চাই জ্যান্ত, তার মধ্য হইতে আবার খুকি। খানিক ভাবিয়া সে উত্তর করিল, তুই কুমড়ার ছক্কা খাইবি? বড় উৎকৃষ্ট খাইতে। অথবা কাঁচকলার ডালনা? কচি-বেলায় তোকে অনেক খাওয়াইয়াছিলাম না?" যৌবনানন্দ কোনও কথা কহিল না। গুম হইয়া বসিয়া রহিল।

"তুই তো এমন অবাধ্য ছিলি না। তোর এমন মতি হইলো কেন?", কহিল জীবনকিশোর।

যৌবনানন্দ খানিক নালিশ জানাইবার সুরে কহিল, "কেন, সেদিন পুকুর ঘাটে দুই দণ্ড দাঁড়াইতে কি হইয়াছিল? কেদার চাটুজ্জের কচি ডাগর-ডুগুর বউটি কেমন ডুম্বুর গাছের ডালে বসিয়া পা দিয়া জলে ছলাৎ, ছলাৎ শব্দ করিতেছিল শাড়ি কাপড়ের দিকে কোনও ভ্রূক্ষেপই ছিল না। একটি পা নামিতেছে, তো অন্য পা উঠিতেছে, সেটি নামিতেছে তো অন্যটি উঠিতেছে। নিশ্চয় নাইতে আসিয়াছিল। আচ্ছা, আমাকে কি এতটুকুও বিশ্বাস করিতে পারো না? তেমন কিছু অঘটন বাধাইতাম না, ইহা নিশ্চিত বলিতে পারি।"

উত্তরে জীবনকিশোর কহিল, "বাপ, এক্ষণে কি আর আমার সেই বয়স আছে? লোকে দেখিলে কি কহিবে? আর রসকে তো দিন, দিন যেদিক, সেদিক দিয়া বাড়িয়া  চলিতে দেওয়া যায় না। বুঝিয়া কাজ করিতে হয়। দিনকাল ভালো নয়।" 

"তবে তুমি তোমার বয়সের ভার, ধুতির কোঁচা আর বুড়া দন্ত সামলাও। আমি চলিলাম। এমন নুইয়া পরা মানুষের সহিত আমার বনিবে না", কহিল যৌবনানন্দ।

"কেন রে, তোকে সেদিন বৈকালে হাটের পথে নেত্যকালির সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিলাম না? কি সুন্দর কথা কয় নেত্যকালি। চোখে মুখ হইতে যেন রূপ-লাবণ্য ঝরিয়া, ঝরিয়া পরিতেছিল। ঠিক যেন পাকা নেংরা আমটি।" জোর গলায় কহিল জীবনকিশোর।

"তোমার ভীমরতি হইয়াছে, জীবনকিশোর, তোমার ভীমরতি হইয়াছে। ওই নেত্যকালিকে দেখিবামাত্রই তো মনে হইলো কোনও কয়লার খনিতে উহার জন্ম। আর অঙ্গের এখান ওখান হইতে যেন ন্যাকড়ার পুঁটুলি ঝুলিতেছে। চেহারার কোনও ছিরিছাঁদ আছে? তায় আবার কহিল পাঁচ সন্তানের জননী। তোমার অধীনে থাকিলে গলায় তেঁতুল বীচি আটকাইয়া আমি মরিব, ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই। এক্ষণে দিন পালটাইয়া  গিয়াছে। কচি, কচি কাঁঠালচাঁপার দল খোলামেলা শরীর-মন লইয়া নলেন গুড়ের পিঠা-পায়াস সাজিয়া যত্রতত্র ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আমার মন আর শান্ত থাকিতেছে না। আমি  পিঠা-পায়াস, পরমান্ন খাইতে চাহি। তোমাকে অবলম্বন করিয়া আর দিন চলে না।", কহে যৌবনানন্দ।

জীবনকিশোর মনে বল সঞ্চয় করিয়া কহিল, "বুঝিলাম, তোর কথা। তবে কিনা এক্ষণে নলেন গুঁড়ে আর আগের মত মিষ্টও নাই, সুবাসও নাই। আর ওই সব পিঠা-পায়াস যা দেখিতেছিস, তা সকলই লবণাক্ত। তোকে বরং আম, কলা আনিয়া খাওয়াইব, অথবা কচি বেলের মোরব্বা। তুই কেমন কলা খাইতে ভালবাসিতি।"
"তোমার ওসব কথায় আর ভুলিতেছি না। কিছুদিন আগে একবার জালের পোশাক পরা টিকিট লাগানো রাঙা, রসালো আপেল খাইতে চাহিয়াছিলাম তোমার কাছে। তুমি কহিয়াছিলে উহা টক। বেবাক মিথ্যা কথা। ঘ্রাণেই বুঝিয়াছিলাম উহা অতীব মিষ্ট। পরে জানিয়াছি উহা বিদিশীও বটে। আমার পাওনা গণ্ডা মিটাইয়া দাও। আমি বিদায় লই।", কহে যৌবনানন্দ। 
"ঠিক আছে। তুই যখন যাইবিই স্থির করিয়াছিস তখন তোকে আর ঠেকাইব না। তা তোর পাওনা গণ্ডা কিসের শুনি?" প্রশ্ন করে জীবনকিশোর।
যৌবনানন্দ চুপ করিয়া থাকে।
কহিয়া চলে জীবনকিশোর, "আমি যদি হই নদী, তুই আমার স্রোত। নদী না থাকিলে তো স্রোতের কোনও অস্তিত্বই নাই। জানিবি, আমাকে ছাড়িয়া তুই বাঁচিবি না। সাগরে নিঃশেষ হইবার আগে পর্যন্ত নদীকে অবলম্বন করিয়াই স্রোতকে চলিতে হয়। আমার মধ্যা দিয়াই তোর মুক্তি।"
খানিক ভাবিয়া যৌবনানন্দ অবশেষে কহিল, "তবে চলো, বিলাপ ছাড়িয়া দুইজনে মিলিয়া অস্তগামী দিবাকরের আলোয় ভর করিয়া পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার শোভা দেখিতে, দেখিতে ভালোলাগা ও ভালবাসার ঊর্ধ্বে উঠিয়া যৌবনকে নূতন করিয়া প্রেমের আলোকে দর্শন করি।"
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...